বেলপাহাড়ী ঘুরতে আসুন ,কিন্তু, স্পট দেখতে নয়...@ বিচিত্র গুপ্ত...


বেলপাহাড়ী ঘুরতে আসুন ,

কিন্তু,  স্পট দেখতে নয়......

@ বিচিত্র গুপ্ত


'ইউ টিউব ভিডিও দেখে ,বেলপাহাড়ী এসেছিলাম। কিন্তু ঘাগরা গিয়ে দেখি জল নেই।'

'কেটকী ঝর্ণায় গেলাম কিন্তু কোন ঝর্ণায় দেখতে পেলাম না। কি আছে দেখার সেখানে??'

কাকড়াঝোর এ তো কিছুই দেখতে পেলাম না। কেন যে গেলাম ওখানে???

আর ঢাঙিকুসুম এর হুদহুদি জল প্রপাত এ এক ফোঁটা জল ও নেই। সেখানে যাওয়াটাই বৃথা হলো।'

এমন অভিজ্ঞতা কেবল মাত্র আপনার একার নয়। অনেকের। ইউ টিউব ভিডিও , ব্লগ এর বিভিন্ন লেখা , নিউজ পেপার এর খবর দেখে উৎসাহিত হয়ে অনেক ভ্রমন পিপাসু মানুষ বেলপাহাড়ী আসতে চান এবং বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর , হোটেল ,হোম স্টে মালিক কে ফোন করে জানতে চান , ঝাড়গ্রাম বেলপাহাড়ীতে কি কি দেখার আছে???

উত্তরে সবাই যেটা বলেন সেটা এই রকম। কনক দুর্গা মন্দির, চিল্কিগড় রাজবাড়ী, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ী , কৃষ গার্ডেন, মিনি জু, খোঁয়াব গাঁ, ট্রাইবাল মিউজিয়াম, ঘাগরা জল-প্রপাত, লালজল গুহা , গাডরাসিনী পাহাড়, খাঁদারানী জলাধার , কাঁকরাঝোর , ময়ূর ঝর্না, কেটকী ঝর্না ,হুদহুদ জল-প্রপাত, পবন পাহাড় ইত্যাদি ইত্যাদি।
এছাড়াও তপোবন, ঝিল্লি পাখিরালয়,সুবর্নরেখা নদী, রামেশ্বরম , হাতি ডোবা ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখানে বলে রাখা ভালো , কেবল মাত্র উপরের স্থান বা স্পট  গুলো দেখার মন বাসনা নিয়ে ঝাড়গ্রাম এলে অনেকেই হতাশ হতে পারেন। বরং ঝাড়গ্রাম বেলপাহাড়ী ঘুরতে এসে উপরের স্থান গুলো কে অতিরিক্ত ঘুরতে যাওয়ার স্থান হিসাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। সময় থাকলে তবেই ওই জায়গা গুলোতে যাবেন।  ওই জায়গা গুলো দেখার জন্যে আসলে ঝাড়গ্রাম নয়।

তাহলে ?? তাহলে কি দেখার জন্যে ঝাড়গ্রাম যাবো??

এখানে একটা প্রশ্ন আছে ।  যারা দীঘা তাজপুর ইত্যাদি জায়গাতে যান তারা কি দীঘাতে কোন কোন পার্ক আছে , মিউজিয়াম আছে , মন্দির আছে সেই গুলো দেখার জন্যে যান, না কি সমুদ্র দেখা ,সমুদ্রে স্নান করা ,সমুদ্রের তীর বরাবর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যে যান? নিশ্চয় মূল আকর্ষণ সমুদ্র।


ঠিক তেমনই ঝাড়গ্রাম , বেলপাহাড়ী, নয়াগ্রাম,গোপী বল্লভ পুর। এখানে আসুন মূল উদ্দেশ্য এটা নিয়ে যে , প্রকৃতিকে উপভোগ করবেন। জঙ্গল উপভোগ করবেন। পাহাড় উপভোগ করবেন। এখানকার হাজার হাজার বছর ধরে বহমান কৃষ্টি সংস্কৃতি কে উপভোগ করবেন।এই অঞ্চলের মানুষের জীবন যাপন ,খাদ্য অভ্যাস , এখানকার গ্রামীণ হাট, লোক উৎসব  অনুষ্ঠান ,এই অঞ্চলের পূজো, সমৃদ্ধ সঙ্গীতের ধারা, এই অঞ্চলের নাচ , পরব , এই অঞ্চলের ভাষা , এই অঞ্চলের পশু পাখি কীট পতঙ্গ ,ইত্যাদি কে কাছ থেকে , ভিতর থেকে পর্যবেক্ষণ করতে ,উপভোগ করতে আসুন।

এই অঞ্চলের নিজস্ব খাবারের স্বাদ নিতে আসুন। ছয়টি ঋতুতে প্রকৃতি কি ভাবে নিজের রূপ রস বর্ন গন্ধ পরিবর্তন করে নেয় সেটা কে উপভোগ করতে আসুন। মাইলের পর মাইল শাল মহুয়া কেঁদু, পলাশের বন উপভোগ করতে আসুন। পাহাড় জঙ্গল এর মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নামহীন ছোট্ট নদীর গতিপথ উপভোগ করতে আসুন। শাল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সকালের সূর্যোদয়, দুপুরের সূর্য কিংবা বিকেলে সূর্যাস্ত উপভোগ করতে আসুন। পাহাড় জঙ্গলের মাঝে বিক্ষিপ্ত ভাবে গড়ে ওঠা ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম , বাড়ি ঘর , সেখানকার মানুষের নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন উপভোগ করার জন্যে আসুন । লাল মাটির আঁকা বাঁকা ঢেউ খেলানো পথে খালি পায়ে হাঁটার যে মজা সেটা উপভোগ করতে আসুন। প্রকৃতির কোলে ,প্রকৃতির বুকে ,নিজেকে হারিয়ে নতুন ভাবে খুঁজে পাওয়ার জন্যে আসুন। আপনি মুগ্ধ হবেনই হবেন।দেখবেন এখানে মানুষের জীবন ও জঙ্গল, জঙ্গল এবং জীবন কেমন যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।কোন তাড়াহুড়ো নেই।ছোটাছুটি নেই । দৌঁড় ঝাঁপ নেই।আপনিও না হয় কোন বিশাল মহুয়া গাছের নিচে কিছুক্ষন বাবুই দড়ি দিয়ে বোনা কাঠের খাটিয়ার উপর শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের কোন জগতে হারিয়ে গেলেন, ক্ষতি কি! ধামসা মাদল নিয়ে আপনিও না হয় নেচে উঠলেন ,পায়ে পা মিলিয়ে ছন্দে ভাসলেন টুসু, বাঁদনা, বাহা পরবে। শাল পোড়া চিকেন কিংবা কালোই ভাজা ,  শাল পাতায় তৈরি মাংসের পিঠে কিংবা কুরকুটের চাটের সাথে হারিয়া ময়ুয়ার অমৃত রসে ডুবে গেলেন!

ঘাগরা জলপ্রপাত দেখতে গিয়ে কোন জলই দেখতে পেলেন না, তাই বলে মন খারাপ করবেন না। ভালো করে দেখুন শাল জঙ্গলের মাঝে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যে প্রাগৈতিহাসিক পাথর খন্ড রয়েছে সেটি তারাফেনী নামক নদীর জল প্রবাহে কি ভাবে ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিভিন্ন অবয়বের রূপ নিয়েছে।সেই রূপ উপভোগ করুন।ভালো লাগবে।

কাঁকরাঝোর গিয়ে গাড়িতে বসে কোথাও কিছু দেখতে পারছি না ,বলে মন খারাপ করবেন না। গাড়ি থেকে নেমে পড়ুন। পায়ে হেঁটে শাল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে যে রাস্তা নিরুদ্দেশের পথে চলে গেছে সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে যান।নাক, কান ,চোখ ,শরীরের ত্বক সজাগ রাখুন। কিভাবে শাল গাছের পাতা গাছ থেকে ঝরে বাতাসে ভাসতে ভাসতে জঙ্গলের পাতার ফাঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে। শুনুন নাম না জানা পাখির আনন্দ ধ্বনি। গাছের গায়ে মাকড়সার জাল, সারি দিয়ে হেঁটে যাওয়া পিপড়ের সারি। বুনো ফুলের উপর নৃত্যরত প্রজাপতি। কিম্বা হটাৎ করে কর্কশ স্বরে ডেকে বনের ভিতর দৌঁড়ে যাওয়া ময়ূর।অথবা শুনুন চেরাং পোকার অবিরাম ঝিঁ ঝিঁ ডাক। জঙ্গলের মধ্যে দাড়িয়ে থাকা কালো কালো বিভিন্ন বিমূর্ত অবয়বে যে গাছ গুলো দাড়িয়ে আছে,সেই গুলো কেঁদু গাছ।এই গাছের পাতা থেকেই তৈরি হয় বিড়ি।


প্রায় শুকিয়ে যাওয়া কেটকী ঝরনার বাম পাশে বিস্তীর্ণ গল্ফ কোর্সের মত ঢেউ খেলে যাওয়া মাঠ।ওপাশে চেরাং পাহাড়। ধ - ডাঙ্গর পাহাড়। শাল গেছে ঢাকা। মাটির সরার ঠিক মাঝ খানে যেন এই ছোট্ট ঝর্না।

ঢাঙিকুসুম গিয়ে শুকিয়ে যাওয়া হুদহুদি জল প্রপাতের দিকে যাওয়ার বুনো জংলী পথের দুপাশের জঙ্গল, গাব গাছের উপস্থিতি, পাথরের খাদান , জল বয়ে যাওয়ার পর পাথুরে রেখা ।উপভোগ করুন গা ছমছমে জঙ্গল। বাঁধানো পথ দিয়ে ঢুকে যান গ্রামের মধ্যে । দেখুন কি ভাবে মানুষ পাথর কেটে মূর্তি , থালা বাটি গ্লাস ইত্যাদি বানাচ্ছে। উঠে যান বন দপ্তর এর তৈরি নজর মিনারে। উপর থেকে দেখুন সারি সারি লকাইসিনি, ভোরাপাহাড়, গুরগুরি ইত্যাদি পাহাড় এর দিগন্ত জুড়ে বিস্তার  । মুগ্ধতায় মুগ্ধতায় উদ্বেলিত হয়ে উঠুন ।

দেখবেন কি অসাধারন মাটির একতলা , দোতলা বাড়ি গুলো। প্রতিটা বাড়িতে রয়েছে কলকাতার পুরনো দালানের রক। দেয়ালে স্থানীয় মায়েদের হাতে আঁকা বিচিত্র নক্সা।এই বাড়ি গুলো বিশেষ ভাবে তৈরি ।বিশেষ ভাবে মানে অগ্নি নির্বাপক।অনেক সময় জঙ্গলে আগুন লেগে যায়।সেই আগুনে যাতে ঘরের ভিতরে যারা থাকবে তাদের জীবন হানি না হয়, কিংবা জিনিস পত্র নষ্ট না হয়, সেই দিকে খেয়াল রেখে বাড়ি গুলো তৈরি। ফলে বাইরের আগুন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারবে না। এই গুলো উপভোগ করুন।স্থানীয় মানুষ জনের সাথে কথা বলুন।গল্পঃ করুন।ভালো লাগবেই।

বিকেলে ফেরার সময় দেখবেন গ্রামের মানুষ জঙ্গল থেকে ফিরছে।সঙ্গে তাদের পোষ্য গরু ছাগল ভেড়া মোষ। একদিকে পাহাড়ের চূড়ায় অস্ত যাওয়া সূর্য আর একদিকে দল বেঁধে তাদের ঘরে ফেরা। মুগ্ধ হয়ে যাবেন।

এই ভাবে আপনি আপনার নিজের মত করে আরণ্যসুন্দরি ঝাড়গ্রাম জেলা কে উপভোগ করুন। আনন্দ করুন। প্রাকৃতিক অনাবিল উচ্ছলতায় ভেসে যান। এখান কার প্রকৃতির পাহাড় জঙ্গল জনপদ তাদের সৌন্দর্য আপনার জন্যে সাজিয়ে রেখেছে। ইচ্ছে হলে আপনি খেজুর কিংবা তাল পাতার বাঁশি বানিয়ে বাজিয়ে নিজের ফেলে আসা ছোট বেলায় ফিরে গেলেন।কিংবা বিভিন্ন আকারের পাথর সাজিয়ে বানালেন বিমূর্ত সব প্রতিকৃতি।আপনি আপনার মত ,শহরের জন কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে , প্রকৃতির মাঝে কাটিয়ে যান। শুধু তথাকথিত " স্পট " গুলোতেই যে যেতে হবে এমন কোন দিব্যি কেউ কিন্তু দেয় নি।সুতরাং .....











Comments

Popular posts from this blog

বেলপাহাড়ীর ঘোরার জায়গা গুলোর লিস্ট

গাড়ি ভাড়া /ঝাড়গ্রাম - বেলপাহাড়ী ট্যুর

বেলপাহাড়ীর হোম স্টে ও রিসোর্ট নাম্বার@ বিচিত্র গুপ্ত