ঘাগরা // বিচিত্র গুপ্ত
ঘাগরা / বিচিত্র গুপ্ত
স্থানীয় শব্দ ' গাগরি/ গাগর ' থেকে ' ঘাগরা ' শব্দটি এসেছে। গাগর/গাগরি শব্দের অর্থ কলসি বা ঘড়া। বেলপাহাড়ীতে ঘাগরা নামের যে অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটন স্থানটি রয়েছে,সেটি মূলত প্রাগৈতিহাসিক নদী তারাফেনীর বুকে অবস্থিত। তারাফেণী নদীর প্রবল জল স্রোতের ঘূর্ণিতে বিস্তীর্ণ পাথুরে ভূ- খন্ড ক্ষয়ে ক্ষয়ে কলসির আকারের ভূমিরূপ তৈরি করেছে। নদীর গতিপথের উচ্চ প্রবাহে তৈরি যে ভূমিরূপ আসলে Pot Hol বা মন্থ কূপ নামে পরিচিত , এই ঘাগরার ভূমিরূপ ঠিক তাই। এখানে গভীর শাল গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নদী ইংরেজি S এর আকার নিয়েছে। পাথরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতে গিয়ে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে তৈরি হয়েছে একটি অতি সুন্দর নাতি উচ্চ জলপ্রপাতের। বর্ষা কিংবা বর্ষা পরবর্তী কয়েক মাস এর রূপ সর্বোত্তম জায়গায় পৌঁছয়। ব্রিটিশ ভারতে এই মনোরম স্থানটি বেলপাহাড়ী র নীলকর সাহেবদের অবসর কাটানোর এবং বহিরাগত বিদেশি বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে বনভোজন করার জায়গা । আজ থেকে প্রায় ১৪০ বছর আগে এখানকার নীলকুঠির নীলকর সাহেব ফ্রেডরিক রাইজ বারোজ বর্ষা শেষ হলে ঘোড়ায় চেপে শাল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বড়শোল - জাম্বনির নীল কারখানায় যাওয়ার সময় গভীর জঙ্গল থেকে জলপ্রপাতের শব্ধ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে যান। কৌতুহল বশত সেই শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে গেলে, অবাক হয়ে দেখেন ঘাগরাজল প্রপাতের অপরূপ সৌন্দর্য। এরপর থেকে এটি নীলকর সাহেবদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯৭৬- ৭৭ সালে এখানে বাংলা চলচ্চিত্র ' বেহুলা লক্ষিনদর ' এর শুটিং এর পর বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর পর এখানেই আরো বহু বাংলা সিনেমা , সঙ্গীত ইত্যাদির শুটিং হয়েছে ।
তারাফেনীনদীর পূর্ব পাড়ে ঘাগরা এবং কৃষ্ণপুর গ্রাম। পশ্চিম পাড়ে রয়েছে চাঁদাবিলা গ্রাম।
এখানেই রয়েছে ঘাগরাসীনি দেবীর পীঠস্থান। প্রতিবছর ১ লা মাঘে বসে টুসু মেলা। স্মরণাতীত কাল থেকে এখানে মকর পরব/ টুসু মেলা বেশ ধুমধামের সাথেই পালিত হয়ে আসছে ।
প্রসঙ্গত এই ছোট নাগরপুর মালভূমি অঞ্চলে ' ঘাগরা ' নামে অসংখ্য স্থান রয়েছে। বেলপাহাড়ী ইন্দিরা চক থেকে বেলপাহাড়ী ঘাগরা এর দূরত্ব ৫.৩ কিমি। ঝাড়খণ্ডের গোটাশীলা এর কাছে রয়েছে আরো একটি ঘাগরা, যার দূরত্ব প্রায় ১৮ কিমি। ১৮৩ কিমি দূরে ঝাড়খণ্ডের চক্রধরপুরের বাঁধগাঁও এর কাছে আরো একটি অনিন্দ্য সুন্দর ঘাগরা রয়েছে। বর্ধমানের পাত্রসায়র থেকে পানাগড় যাওয়ার পথে ঘাগরা নামক একটি জায়গা রয়েছে।পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা রোডের প্রয়াগ ফিল্ম সিটির কাছে ধুরাশোলে এবং খড়গপুরে ঘাগরা নামে জায়গা রয়েছে । বাঁকুড়ার রানীবাঁধ অঞ্চলেও ঘাগরা আছে ।এমনকি উড়িষ্যার বালাঙ্গীর জেলাতেও রয়েছে ঘাগরা নামের গ্রাম।অর্থাৎ পাথুরে ভূমির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ছোট্ট নদী বা জলধারার ক্ষয় কার্যের ফলে তৈরি হওয়া কলসির মত ভূমিরূপ যুক্ত জায়গার নাম হয়ে গেছে ঘাগরা।
ভারতের উত্তর প্রদেশে এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে ' ঘাগরা ' নামে রয়েছে একটি করে নদী।
বাংলাদেশ এর রাজধানী ঢাকা নগরী তেও রয়েছে ' ঘাগরা ' নামের একটি স্থান। পাকিস্থানের পাঞ্জাব রাজ্যের মুলতান এর মুলতান পাবলিক স্কুল রোডে রয়েছে ' ghagra villas ' নামের একটি বহুতল বাড়ি।
বাংলার নদী বা জলাশয় তীরবর্তী স্থানে ছোট্ট ছোট্ট কাটা ফল যুক্ত একটি গাছ দেখা যায় ,অনেকে সেই গাছ কে ' ঘাগরা ' বলে। আগরা নামেও পরিচিত এই গাছ। এর বিজ্ঞান সম্মত নাম
'Xanthium strumarium '। আমরা ছোট বেলায় এই ফল দুষ্টুমি করে মাথার চুলে আটকে দিতাম।
রাজস্থান এবং গুজরাটে নারীদের ' চোলি ' জাতীয় একটি পরম্পরাগত পোশাকের নাম ' ঘাগরা/ ঘাগরা চোলি '।
@ বিধান দেবনাথ // বেলপাহাড়ী
Comments