পাহাড় পুজো : কানাইসর / বিচিত্র গুপ্ত

পাহাড় পুজো : কানাইসর

@ বিচিত্র গুপ্ত


স্থানীয় সঙ্গীত,সাহিত্য,কৃষ্টি,সংস্কৃতি ,আবেগ ,অনুভূতি ,উন্মাদনা ,ভালোবাসা ,প্রেম তথা ঐতিহ্য ও বংশানুক্রমিক পরম্পরা হিসাবে প্রকৃতি পুজোর যে বিশ্বজনীন ইতিহাস বহমান, তা এই অঞ্চলের মানুষের কাছেও অনুসৃত হয়ে আসছে স্মরণাতীত  কাল ধরে, পাহাড় পুজো তারমধ্যে  অন্যতম।

এই  পরম্পরা অনুসরন করেই,প্রতি বছর আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবার, ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর দুই নম্বর সমষ্টি উন্নয়ন অঞ্চলের অন্তর্গত সন্দাপাড়া গ্রামপঞ্চায়েতের অধীনে, পশ্চিমবঙ্গ  ও ঝাড়খন্ড রাজ্যের  মধ্যবর্তী সীমানায় অবস্থিত, কানাইসর পাহাড়কে কেন্দ্র করে যে প্রকৃতি পুজোর আয়োজন  হয়, সেটাই কানাইসর পাহাড় পুজো নামে পরিচিত। কেউ কেউ বলেন কানাইশর/ কানাইশহর পাহাড় পুজো।। 

ভারত বর্ষের পাঁচ রাজ্য যথা পশ্চিম বঙ্গ, ঝাড়খন্ড , বিহার, ছত্রিশগড় ও উড়িষ্যা জুড়ে বিস্তৃত ছোট নাগপুর নামক যে মহাদেশীয় মালভূমি অবস্থান করছে, তারই অন্তর্গত একটি নাতিউচ্চ পাহাড় এই কানাইশর। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে এর উচ্চতা আনুমানিক ৩০০ মিটার থেকে ৩৩০ মিটার অর্থাৎ ৯৮৫ ফুট থেকে ১০৮৩ ফুট।মূলত গ্রানাইট , নিস, হেমাটাইট , কোয়ার্টজাইট পাথর দিয়ে গঠিত এই পাহাড়।৫০ মিলিয়ন বছর  আগে ক্রিটেশিয়াস যুগে  ছোট নাগরপুর মালভূমি সৃষ্টির প্রাক্কালে এই পাহাড়ের সৃষ্টি বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান ।


এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের  উল্লেখ যোগ্য কয়েকটি পাহাড় পুজো যথা গাডরাসিনী পাহাড় পুজো, হাতিমারা পাহাড় পুজো, গোটা শীলা পাহাড় পুজো ইত্যাদি  হলেও কানাইসর পাহাড় পুজোই যে অপেক্ষাকৃত প্রাচীন এবং সর্বাধিক পরিচিত, এবিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই । 

জনশ্রুতি ,পাশাপাশি দুটি পাহাড়। একটির নাম রাজাপাহাড় ,আরেকটির নাম রাণী পাহাড়। কথিত আছে ,এখানকার পাহাড়ী গুহায় বাস করতেন  জঙ্গলের এক রাজা এবং তার রাণী।এই রাজাকে ' ঠাকুর ' এবং রাণীকে ' ঠাকুরানী ' বলেও ডাকা হতো, এমন জনশ্রুতিও আছে ।যায় হোক, পূর্ব থেকে পশ্চিম দিক বরাবর এই পাহাড় দুটোর অবস্থান বা বিস্তার। পূর্ব দিকের পাহাড় রাজার খুব পছন্দের।সেটি রাজা পাহাড়। পশ্চিমের পাহাড়টি রানীর পছন্দের।সেটি রাণীপাহাড়।রাজা শিকার করতে ভালো বাসতেন। জঙ্গলে ঘুরে বরা (শুয়োর), সজারু , বন খরগোশ ,পাখি ইত্যাদি শিকার করতেন ।

প্রসঙ্গত এই পাহাড় দুটোর সাথেই পশ্চিম দিকে আরও অনেক গুলো ছোট ছোট পাহাড়ের বিস্তার ঘটেছে , যেগুলোর বিস্তার গোটাশিলা, ঢাঙ্গীকুসুম , কাকড়াঝোর, ঝাটিঝর্না ,বুরুডি ড্যাম হয়ে দুয়ারসিনির দিকে চলে গেছে । রাজা পাহাড় , রাণীপাহাড় লাগোয়া একই সারি তে ,পশ্চিম দিকের পাহাড় ও পাহাড়ী জঙ্গলে ছিলো বরাহ ( বরা/ শুয়োর)  অর্থাৎ বুনো শুয়োরের বিচরণ ক্ষেত্র।  অর্থাৎ বরাহ দের ঘাটি। এটি এখন বারহাঘাট নামেই পরিচিত। 

এই দুই পাহাড়ের মাঝ খানে , অর্থাৎ রানী পাহাড়ের পূর্ব দিক , আর রাজা পাহাড়ের পশ্চিম দিক ,সীমানা বরাবর উচু একটু পাথরের থান ছিল। এখানে রাজা রানি পুজো করতেন  । এটি 'দে হরির ' থান বলে পরিচিত ছিল ।  হরির  দেবতার থান। অর্থাৎ এখানে ঈশ্বর হিসাবে ভগবান কানাই ,অর্থাৎ কৃষ্ণের পুজো হত। অর্থাৎ সেই রাজা এবং রাণী এই ভগবান ' কানাই ঈশ্বর ' কে পূজো করতেন।পাহাড়ের পাথর দিয়ে সেখানে একটি মন্দিরও তৈরি করেছিলেন।সেই মন্দিরের  জীর্ণ ধ্বংসাবশেষ এর কথা আজ থেকে ১০২ বছর আগে ১৩২৮ বঙ্গাব্দ নাগাদ প্রকাশিত " মেদিনীপুরের ইতিহাস " গ্রন্থে শ্রী যোগেশ চন্দ্র বসু মহাশয় উল্লেখ করেছেন ,' একস্থানে একটি জীর্ণ প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয় । এই রূপ কিংবদন্তি যে, পূর্বে ওই স্থানেই পাহাড়ের পূজা হইত।' 

এই রাজা এবং রানীর মধ্যে মাঝে মধ্যে ঝগড়া ঝাটি হত। বিভিন্ন কারণেই । কথিত আছে, রাজা এবং রাণী দুজনেই জঙ্গলে ঘুরতে বের হয়েছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে পাহাড় জঙ্গল ঘেরা একটি প্রশস্ত জলাশয়ের কাছে উপস্থিত হন। সেখানে কোন কারণ বশত রাজার সাথে রানীর মন মালিন্য হয়। শুরু হয় কলহ। বাগ বিতণ্ডা। রাজা ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে হাতের শিকারের জন্য রাখা অস্ত্র দিয়ে রানীর নাক কেটে দেন । এবং এই ঘটনার পরে সেই রাজা এবং রাণীর আর দেখা পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি সেই পাহাড় ঘেরা জলাশয় আজকের ' খাঁদারাণী ' । আর সেই রাজা এবং রাণী দ্বারা পূজিত ' কানাই ইশ্বর ' এর পাহাড়  ' কানাইশর পাহাড় ' । কানাই + ঈশ্বর = কানাইশ্বর । ক্রমে লোক মুখে হয়ে গেছে , কানাইশর / কানাইসর/ কানাই শহর ।

বর্ষা শুরু হলে, স্থানীয় মানুষ চাষ আবাদে মেতে উঠতেন।  জমি তৈরি করা। ধানের পাতো দেওয়া। সেই পাতো তুলে তৈরি করা জমিতে বোনা সম্পূর্ন হলে , রাজা আদেশ দিলেন , একটু সবাই মিলিত হয়ে যদি পুজো করা হয়, এবং সেই পুজো উপলক্ষে সবাই এক জায়গায় মিলিত হয়ে খাওয়া দাওয়া করা হয় ,তাহলে বেশ  হয়। কিন্তু একটা শর্ত দিলেন, সেই উৎসবে কোন নারী উপস্থিত হতে পারবে না। কারণ কি ? কারণ সহজেই অনুমেয় , রাজা বিভিন্ন কারণে যেহেতু রাণীর উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন ,সেই কারণে এই রকম বিধান। 

প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের প্রথম রবিবার এই বিশেষ পুজো এবং উৎসব এর সূচনা হলো। পাহাড়ের উপরে ' হরির থানে ' এই পুজো হলেও, সেখানে কোন রকম পশু বলি দেওয়া যাবে না। রাণী পাহাড়ের পূর্বদিকে অপেক্ষাকৃত নিচু স্থানে অবস্থিত বড় মেগালিথ পাথরের থানে হবে পশু বলি এবং পুজো। যিনি পুজো করতেন তাকে বলা হতো ' দেহরী ' অর্থাৎ হরি দেবতার পূজারী ' ।  ছাগল , মোরগ ,পায়রা ইত্যাদি বলি দিয়ে পুজোয় উৎসর্গ করা হবে। এবং সেই মাংস সবাই এক স্থানে উপনীত হয়ে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করবে। সেই সঙ্গে আরও দুটো নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। রান্না করা মাংস কোন অবস্থায় বাড়ি তে নিয়ে যাওয়া যাবে না। অবিবাহিত মহিলা, সন্তান সম্ভবা বিবাহিত মহিলারাও এই প্রসাদ  খেতে পারবে না।দ্বিতীয়ত পাহাড়ের পূর্ব দিক দিয়ে , উত্তর  থেকে দক্ষিণ দিকে বয়ে চলা ডুলুং নদী পাড় হয়ে নদীর পূর্ব পাড়েও যাওয়া যাবে না।যিনি পুজো করবেন তিনি থাকবেন প্রাকৃতিক অর্থাৎ নিরাভরণ।যদিও বর্তমানে এই নিয়মের অবসান হয়েছে দেখা যায়।বর্তমানে এই পুজোর দায়িত্ব কেন্দাপড়ার শবর সপ্রদায় এর মানুষের উপর। 

সিতাপুর,মধুপুর কিংবা লোয়াদা থেকে বুরুডি গ্রাম বাম দিকে রেখে যে পাহাড়ী রাস্তা পাহাড় টপকে কাকরিঝর্না , ডাকাই গ্রামের দিকে উঠে গেছে , সেই পথের দু পাশে রাজা পাহাড়ের পাদদেশে বসে এই উৎসব পালিত হয় এবং বলি দেওয়া পশুর মাংস রান্না করে খাওয়া হয় ।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ,এই পুজোয় কোন দোকান পাট বসে না। মূলত চারপাশের গ্রাম গুলো থেকেই মানুষের সমাগম ঘটে।

জনশ্রুতি আছে , রাণী চাষবাস পছন্দ করতেন।জঙ্গলে জঙ্গলে শিকার করে পশু শিকার পছন্দ করতেন না। পছন্দ করতেন না নিরীহ পশু বধ করে রক্ত পাত ঘটানো অথচ রাজার কাছে , জঙ্গলে ঘুরে পশু শিকার করা ছিল নেশার মত।এই নিয়েই রাজা রানীর কলহের সূত্র পাত। এই কারণে রাজা রানীর বিরুদ্ধে গিয়ে এই উৎসবের সূচনা করেছিলেন ,যেখানে শুধু নিজের রাণীই নয়, অন্য কোন নারীও যেন এখানে আসতে না পারে,এমন বিধান দিয়েছিলেন । কৃষি কাজে চারা রোপণ শেষ হলে একটু সবাই মিলে পশু বলি দিয়ে খাওয়া দাওয়া করে দেবতা কে সন্তুষ্ট করা এবং ফসল যাতে ভালো হয় ,সেই জন্যে ' কানাই ঈশ্বর " এর কাছে প্রার্থনা করা,এমনটাই মনে করা হয়।

 এদিকে ,আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবার যে পাহাড়ে পুজো হয় , সেটাই আসলে রাণীপাহাড়। এই রাণী পাহাড়ই ' কানাইসর ' পাহাড় নামে পরিচিত। এই পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বড় বড় প্রাচীন জাম গাছ। রয়েছে শাল মহুয়া কেঁদু গাছ। পাহাড় লাগোয়া একটি সুবিশাল পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত মেগলিথ পাথর। এই পাথরটি হলো  দ্বিতীয় পূজার স্থান। পুজোর এই থানের পূর্ব দিক দিয়ে পাহাড়ের শীর্ষ দেশে পৌঁছানোর যে রাস্তা সেটি সব থেকে পুরনো রাস্তা। পশ্চিম দিক দিয়ে পরবর্তী কালে আরো একটি রাস্তা উপরে ওঠার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে। এই দুই রাস্তা দিয়েই পায়ে হেঁটে পাহাড়ের শীর্ষ দেশে পৌঁছতে হয়। শীর্ষ দেশে পৌঁছনোর প্রায় ২০ ফুট নিচে , পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত রয়েছে গ্রানাইট পাথরের সুবিশাল দেয়াল। রয়েছে পুজোর প্রথম থান। এখানেই ছিল এক সময় সেই রাজা রানীর বসবাসের গুহা ,যদিও কালের বিবর্তনে সেই গুহা কিংবা গুহা মুখের অস্তিত্ব বর্তমানে বিলুপ্ত। রাজা রানী অন্তর্ধানের পর থেকে এখানেই পুজোর প্রবর্তন হয়। পাহাড়ের শীর্ষ দেশ সমতল। এই সমতল বরাবর পূর্ব দিকের শেষ প্রান্তের কাছকাছি আরো একটি প্রাচীন থান আছে। পাথর ও পাথরের ধ্বংসাবশেষ দেখে অনুমান করা যেতে পারে, এখানেই হয় তো যোগেশ চন্দ্র বসু উল্লেখিত সেই প্রাচীন মদিরের অবস্থান ছিল। এবং এটাই সেই রাজা রানী দ্বারা পূজিত কানাই বাবার থান।যেহেতু এই পাহাড় টি রানীর প্রিয়, এবং রাণী পশুবধ,রক্ত পছন্দ করতেন না,তাই এখনও কানাইসর পাহাড় পুজোর দিন পাহাড়ের উপরে কোন রকম মাংসাদি আমিষ আহার করা নিষিদ্ধ।এই পাহাড়ের পাদদেশে যেমন মেলা বসে, ঠিক তেমনই শীর্ষ দেশের এই সমতল স্থানেও বসে মেলা।পুজোর দিনে লক্ষ লক্ষ মানুষ ,যেন পাহাড় ,পাহাড়ের পাদদেশ , ঢাল, ঢালের খাঁজ উপ খাঁজে মৌমাছির চাকের মত বিচরণ করতে থাকে , পুজোর প্রার্থনা যে যার মত শেষ করে।

যেহেতু, আষাঢ় শ্রাবণ বর্ষা কাল । এই বিস্তীর্ণ পাহাড় জঙ্গল ঘেরা জনপদে কৃষি কাজ সূচনার কাল। বৃষ্টি না হলে কোন ভাবেই কৃষি কাজের সূচনা করা যাবে না। বৃষ্টি হলে তবেই মাটি নরম হবে। মাটি নরম হলে তবেই মাটি লাঙ্গল দিয়ে কিংবা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে বীজ রোপণ করে পাতো তৈরির ও ধানের চারা লাগানোর উপযোগী করে তোলা যাবে । অতি বৃষ্টি হলে কিংবা বৃষ্টি একবারে না হলে এই কাজ কিছুতেই করা যাবে না। সুতরাং প্রকৃতি কে সন্তুষ্ট রাখতে হবে, যাতে কৃষি কাজের উপযোগী বৃষ্টিপাত হয়। এই উপলক্ষে কানাইসর পাহাড়ে কানাই বাবার থানে সকলে জড়ো হয়ে পুজো করা,প্রার্থনা করা।, রাণীমা এমন টা পছন্দ করতেন। এবং এখানে সকলে এসে মিলিত হয়ে প্রকৃতি পুজো তথা বাবা কানাই এর অবস্থান এই পাহাড় কে পুজো করতেন।সেই ঐতিহ্য এখনও বহমান।প্রতি বছর দুই বার। আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবার এবং শ্রাবণ মাসের প্রথম রবিবার ।

স্থানীয় বহু মানুষের বিশ্বাস, কানাইবাবা আসলে  ' বুড়হা বাবা ' র । 'বুড়হা বাবা ' মানে বাবা ভৈরব। অর্থাৎ বুড়ো বাবা শিব এর অধিষ্ঠান। ওদিকে ,ঢলভূমগড়ের রাজাদের আরাধ্য দেবী ' রংকিনী ' মাতা। ইনি আসলে ভৈরব বাবার ভৈরবী, এমনটাই বিশ্বাস। ভৈরবী অর্থাৎ মা পার্বতী।কেউ কেউ বলেন ইনি মা দুর্গা ।,এই কারণে ঢলভূম কে মাতা রংকিনী র নাম অনুসারে   ' রংকিনীভূম ' ও বলা হত। বুড়হা বাবা হলেন রাজা । রাণী হলেন মা ভৈরবী। এই পাহাড়ে রাজা বা রানীর বাস বলে যে জনশ্রুতি , আসলে তারা বাবা ভৈরব এবং মা ভৈরবী।  অবসর যাপন করতে বাবা ভৈরব এবং মা ভৈরবী এই পাহাড়ে এসে অবস্থান ও করেন ।লোক শ্রুতি।


এই কানাইসর পাহাড় পুজো সম্পর্কে শ্রী যোগেশ চন্দ্র বসুই  সর্ব প্রথম লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন :-
"এই জেলার(তখন অবিভক্ত মেদিনীপুর) পশ্চিম সীমান্তে বীণপুর থানায় কানাইসর নামে একটি পাহাড় আছে। এতদ অঞ্চলের পাহাড় কয়টির মধ্যে ইহাই সৰ্ব্বোচ্চ । প্রতি বৎসর আষাঢ় মাসে এই পাহাড়ে দুইবার পূজা হয় । তদুপলক্ষে বাঁকুড়া, মানভূম, সিংহভূম প্রভৃতি জেলা হইতে লোক আসিয়া থাকে। গিরি-শৃঙ্গের দৃশ্য অতি মনোরম। সেখানে নানা প্রকার অদ্ভুত ও বিচিত্র পুষ্পোদ্যান দৃষ্ট হয় ৷ তথায় প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষও আছে। শিখর দেশ বিস্তৃত; তন্মধ্যে মাত্র ছয় বিঘা ভূমি উদ্ভিদ বর্জিত সমতল ক্ষেত্র। অবশিষ্ট প্রায় পঞ্চাশ ষাট বিঘা ভূমি নিবিড় জঙ্গলাকীর্ণ। একস্থানে একটি জীর্ণ প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয়। এইরূপ কিম্বদন্তী যে, বহুকাল পূর্বে ঐ স্থানেই পাহাড়ের পূজা হইত। কিন্তু বলিদানের পর তথায় কাহারও থাকিবার বা যাইবার অধিকার ছিল না। এক সময় পূজক বলির খড়গটি আনিতে ভুলিয়া গিয়া পুনরার যখন উহা আনিবার জন্য উপরে গমন করেন, তখন দেখেন যে, দেবতা তথায় দুইটি ব্যাঘ্র লইয়া উপবিষ্ট আছেন। দেবতার প্রত্যাদেশ হয়, 'আর কখনও এইস্থানে আসিও না— এবার হইতে নীচে পূজা করিও। তদবধি আর উপরে পূজা হয় না বা সচরাচর কেহ উপরে উঠেও না। দেবতার আদেশে হউক বা না হউক, ব্যাঘ্রের ভয়েই যে পূজকগণ আর অত উচ্চে সেই জঙ্গলাকীর্ণ স্থানের জীর্ণ মন্দিরে বসিয়া পূজা করিতে সাহসী হন নাই তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। পাহাড়টির সানুদেশে 'দে হরির স্থান' নামে একটি প্রশস্ত স্থান আছে, তথায় কতকগুলি বড় বড় প্রস্তর আছে । এক্ষণে পূজা প্রথমে সেইস্থানে হয়। তৎপরে পাহাড়ের পূর্ব্বদিক দিয়া উপরে উঠিবার যে পথ আছে, সেই পথে কিছু দুর উঠিলে যে স্থানে উপনীত হওয়া যায় উহাই পূজার দ্বিতীয় স্থান। স্থানটা অত্যন্ত ঢালু বলিয়া বেশী লোক একত্র তথায় থাকিতে পারে না। একদল নামিয়া আসিলে আবার একদল উপরে যাইতে পারে। পূজার স্থানে প্রায় শত হস্ত দীর্ঘ এবং প্রায় পঞ্চাশ হস্ত প্রস্থ ও তদনুরূপ উচ্চ একটি প্রকান্ড প্রস্তর আছে। উহার মধ্য দিয়া একটি গর্ভ আছে; পূজা শেষ হইলে যাত্রিগণ ঐ গর্ভের উপরে আমলকী ও পুষ্পাঞ্জলি দিয়া নিম্নে হাত পাতিয়া থাকে। পূজারী বলেন, উক্ত আমলকী ও পুষ্প যত শীঘ্র যাহার হস্তে পতিত হয় তাহার মনকামনা তত শীঘ্র পূর্ণ হইয়া থাকে। আর যাহার হস্তে একবারে পড়ে না— তাহার মনস্কামনাও সিদ্ধ হয় না ।পৰ্ব্বত-গাত্রে একটি কূপ আছে। উহার গভীরতা মাত্র দুই তিন হাত হইলেও উহার সঙ্গে একটি ঝরণার সংযোগ থাকায় মেলার সময় পাঁচ ছয় হাজার লোক জলপান করা সত্বেও উহার জল সমভাবেই বৰ্ত্তমান থাকে ; জলও পরিষ্কার"।


কিংবদন্তির সেই পূজারীই  ছিলেন শবর সম্প্রদায় এর মানুষ, এমনটা শোনা যায়। সেই পূজারী /দেহরীর নাম ছিল কানাই।কানাই শবর।রাজা রানী অন্তর্হিত হওয়ার পর তিনি ওই পাহাড়ে পুজোর দায়িত্ব পান। আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবারে , পাহাড়ের  দে হরির থানে ,পুজো করার প্রধান পুরোহিত ছিলেন এই কানাই শবর। পুজোর পর  খড়গ ভুল করে রেখে আসা, দুটি বাঘের দর্শন লাভ ,দৈব বাণী ইত্যাদি যা সব ঘটেছিল , সব এই কানাই শবর কে কেন্দ্র করে। বহু বছর আগে ,আনুমানিক প্রায় ৩০০ বছর আগে এই পুজোর দায়িত্ব শবর সম্প্রদায় এর কাছ থেকে মাল সম্প্রদায় এর হাতে অর্পিত হয়। 

 তবে শ্রাবণ মাসের প্রথম রবিবারের  রাজা পাহাড় পুজোর দায়িত্ব শবরদের উপরেই ন্যস্ত থাকে।এই ' কানাই শবর ' এর নাম  থেকেই ক্রমশ এই পাহাড়ের নাম লোক মুখে হয়ে যায় কানাইসর, এমনটাই অনেকের মত।

কানাই + শবর >কানাই শহর  > কানাইশর > কানাইসর।

বর্তমানে এই পাহাড় পুজোয় প্রায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়ে থাকে। ঝাড়গ্রাম এর পর্যটন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিগত কয়েক বছর এই জন সমাগম বৃদ্ধি পেয়েছে।পাহাড়ের পাদদেশে এবং পাহাড়ের উপড়ের সমতল অংশে বিবিধ মনোহারী দোকান পাট বসে। বসে চাউমিন ,এগ রোল , ঘুগনি,আইস ক্রিম , মাংস রুটি ও ভাতের অস্থায়ী দোকান পাট। পুজোর উপচার নিয়েও বসে দোকান। স্থানীয় খাবার,শিল্প সামগ্রী ও পানীয়র পসরা।বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন বাইক ,বাস সহ অন্যান্য গাড়ি ভাড়া করে এখানে এসে মিলিত হয়। পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে বহু মানুষ পায়ে হেঁটে ,সাইকেলে ,কিংবা টোটো ভাড়া করে উপস্থিত হয়। সারা দিন ,সারা রাত ধরেই এই জনসমাগম ঘটে। তৃতীয় শনিবার এর ঠিক পরের দিন অর্থাৎ রবিবারে ঝাড়খন্ডের দিকেও মেলা বসে ।পুজো হয়। এটা কে বলে ' বারহাঘাট/বারাঘাট ' এর মেলা।' বরাহ ঘাটি ' বা বন শুকরের ঘাঁটি ছিলো বলে ওই স্থানের নাম এমন টা হয়েছে বলে ,স্থানীয় মানুষদের অভিমত।

প্রসঙ্গত ,কানাইসর পাহাড় পুজোর দায়িত্ব বর্তমানে রয়েছে  অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলার চাকুলিয়া ব্লকের কেন্দাডাংরির ঢেঁঙ্গাম গ্রামের  মাল সম্প্রদায় এর সেবাইত শ্রী সহদেব নায়েক (স্বামীজি ),শ্রী রবীন্দ্র নায়েক , শ্রী গৌরাঙ্গ নায়েক এবং শ্রী দানব নায়েক মহাশয়দের হাতে। সহদেব বাবু জানিয়েছেন, বংশানুক্রমে তারাই ' লায়া/দেহরী " হিসাবে এই পুজো করে আসছেন বহু যুগ ধরে। কত পুরুষ আগে থেকে এই পুজোর দায়িত্ব তারা পেয়েছেন সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে না পারলেও , তিনি জানিয়েছেন তার বাবা,দাদু,দাদুর দাদুরও আগে থেকে তাদের বংশের মানুষ এই পুজোর সাথে যুক্ত । অনুমান করা যায় প্রায় ৩০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে এরা এই পুজোর সাথে যুক্ত।এক সময় এই পাহাড় পুজোর দিন আগত ভক্ত গণের প্রিয় খাবার ছিল লুচি ,মাংস এবং কাঠাল। 

Midnapore.in এ ঝাড়গ্রাম জেলার  সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে উৎসাহী গবেষক ধ্রুব মাহাত মহাশয় ' কানাইসোর পাহাড় পুজো ' শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন , 'এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ, বিশ্বাস আছে যে যদি প্রাকৃতিক দেব-দেবীকে তুষ্ঠ রাখা যায় তাহলে সমস্ত মনস্কামনা পুরণ হবে। তাই বছরের বিভিন্ন সময়ে তারা প্রাকৃতিক দেব- -দেবীর পূজা করে। তেমনই বর্ষার শুরুতে আমন ধান চাষের আগে যাতে বৃষ্টি ভালো হয়, কারণ বৃষ্টি পর্যাপ্ত হওয়া মানেই চাষবাস ও ফলন ভালো হবে, সেই কামনায় পাহাড় পূজা করে থাকে।"
"- কানাইসোর পাহাড়ে একদা ঠাকুর-ঠাকুরানী বাস করতেন। তাদের মধ্যে মাঝে-মাঝে অন্তঃকলহ হতো। একদিন তা চরম আকার ধারণ করলে ঠাকুরানী রাগ করে চলে যেতে থাকেন। এমতাবস্থায় ঠাকুরও তার পিছু নেন কলহ গড়ায় পাহাড় থেকে সমতলে। জোড়াম গ্রামের পূর্বে বিরদহ মৌজার কাছে দু- জনের মুখোমুখি হয়। ঠাকুর প্রচন্ড রাগ বসত ঠাকুরানীর নাক কেটে দেয়। এদিকে ভোর হয়ে যাচ্ছে দেখে ঠাকুর-ঠাকুরানী অন্তর্ধান করেন। সেই থেকে জায়গাটি খাঁদারানী নামে পরিচিতি লাভ করে।"
"দেহরী প্রথমে খান্দারানীতে পূজা করে বোম ফাটায় এরপর তারা পাহাড়ে গিয়ে পূজা করে দু-জায়গায়। উপরে অবস্থিত এক বড় পাথরের সামনে ও নীচে জামগাছের তলায় এক গুহার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা শিলায়। শুরু থেকেই ঢেঙ্গাম গ্রামের নায়েক সম্প্রদায়ের লোকেরা দেহরী (পূজারী/লায়া) হিসাবে নিযুক্ত রয়েছে। তবে যে কেউ নিজে-নিজেই এ পূজা করে নিতে পারেন। আগত দর্শনার্থীদের অনেকেই ফল, ফুল নিবেদন করে। কেউবা আবার পারিবারিক মঙ্গল কামনায় পাঁঠা, মোরগ ও পায়রা বলী দেয়।"

"পাহাড়ের উপরে একটা সুড়ঙ্গ ছিল যার ভিতরে কানাই-ঈশ্বর দেবতার অবস্থান ছিল। সুড়ঙ্গের উপরে ছাউনির আকারে একটি বড় পাথর ছিল। এই দেবতার নাম অনুসারেই পাহাড়ের নাম "কানাইসোর"। এখানে প্রাচীন কাল থেকেই এই দেবতার পূজা করা হতো রাতে। পুজার নিয়মানুসারে রাতে পুজার পর দেহরীরা সুড়ঙ্গ ছেড়ে বেরিয়ে আসলে পুনরায় সেখানে যাওয়া বারণ।কারণ ঠাকুর নাকি এ সময় পূজার নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করতে আসেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কোন এক সময়ে দেহরীরা পূজা শেষে নীচে এসে পূজা করার সময় দেখেন যে খড়্গ উপরে ছেড়ে এসেছে। সাত-পাঁচ না ভেবেই দেহরীদের একজন খড়গ নিয়ে অসার জন্য উপরে যায়। বাকীরা তাকে পিছন থেকে পুজার নিয়ম স্মরণ করিয়ে ডাকলেও তা তিনি শুনতে পাননি কারণ এই দেহরীরা বংশ পরম্পরায় কালা যা বর্তমান প্রজন্মে ও লক্ষ্যণীয়।উপরে গিয়ে তিনি দেখেন ঠাকুর স্বয়ং প্রসাদ খাচ্ছেন। তাকে দেখে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করেন কে তুমি ? উত্তর আসে আমি দেহরী, ঠাকুর বলেন আমার সেবক বলে জীবনদান দিলাম খড়গ নিয়ে যাস আজ থেকে এখানে আমার দর্শন আর কেউ পাবে না। এই বলে ঠাকুর তার ঘাড় মটকে রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বাকি জীবন তিনি ঐ অবস্থায় অতিবাহিত করেন। পরের দিন দেহরীরা গিয়ে দেখেন যে সুড়ঙ্গের উপরের ছাউনির পাথরের একটা বড় অংশ পড়ে গিয়ে সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে গেছে সেই থেকে সুড়ঙ্গের মুখে পড়ে থাকা বড় শিলা বা পাথরেই পূজা হয়।"


'জলদর্চি ' পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণ এর " পশ্চিম বঙ্গের লৌকিক উৎসব , পর্ব - ২৭, ( ৩ জুলাই, ২০২২) তে লোকগবেষক ভাস্করব্রত পতি  উল্লেখ করেছেন:

"কানাইসর' নামের মধ্যে দুই দেবতার খোঁজ মেলে।  
                     কানাই + সর > কানাইসর
'কানাই' অর্থে শিব। আর 'সর' অর্থে দুর্গা। এই কানাইসর পাহাড়ের একটি অংশকে বলে 'রাজা' পাহাড়। আর একটি অংশকে বলে 'রাণী' পাহাড়। শ্রাবণ মাসের প্রথম রবিবার রাজা পাহাড়ে কানাইবাবার তথা শিবের পূজা হয়। মুরগী ও পাঁঠা বলি হয়। এই পূজাতে কোনো মহিলার প্রবেশ নিষিদ্ধ। এমনকি এই পূজার প্রসাদও মহিলাদের খাওয়ার বিধান নেই। বিশেষ করে যেসব মহিলাদের এখনো বিয়ে হয়নি বা তাঁদের বাচ্চা হওয়ার বয়স রয়েছে তাঁদের এই প্রসাদ দেওয়া যাবে না। শুধুমাত্র যেসব মহিলা আর সন্তানের মা হবে না, তাঁরাই খেতে পারে। ডুলুং নদী পেরিয়ে নিয়েও যাওয়া যাবেনা কানাইবাবার প্রসাদ। নদীর এপারেই খেতে হবে। কানাইবাবার পূজক হলেন খেড়িয়া শবর গোষ্ঠীর মানুষ কেন্দ্রাপাড়ার সন্তোষ শবর। তিনিই মূল পূজক। 

আর রাণী পাহাড়ে আষাঢ়ের তৃতীয় শনিবার 'সর' মায়ের তথা দুর্গা মায়ের পূজা হয়। এই পূজার পূজক হলেন ঢেঙ্গাআম গ্রামের সহদেব নায়েক। এখানে পাঁঠার পাশাপাশি মুরগি বলিও দেওয়া হয়। লুচি, মাংস ও কাঁঠাল খাওয়ার প্রাচীন চল রয়েছে এখানে। আসলে বর্ষার শুরুতে ভালো চাষের আশায় বৃষ্টির কামনায় পাহাড়পূজায় শামিল হন মানুষজন। প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট রাখার ভাবনায় পাহাড় পূজা। এই কানাইসর পাহাড়ের অর্ধেক অংশ পড়ে বেলপাহাড়ী ব্লকের সন্দাপাড়া পঞ্চায়েতের মধুপুর মৌজায়। বাকিটা পড়ে ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়া ব্লকের মধ্যে। দুই রাজ্যের সীমান্তে কয়েক বর্গমিটার জুড়ে পাহাড়টির অবস্থান।
কানাইসর পাহাড়পূজাতে ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন মৌজার মানুষ ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত থাকেন। সেই গ্রামগুলি হল দুয়ারিশোল, জয়নগর, তুলসীবনি, শালগেড়িয়া, জোড়াআম, কিয়াশোল, বিদ্যহ, ভাণ্ডারু, বৈকুন্ঠপুর, শিলাখুনি, দুবরাজপুর, পচাপানি, বেহারপুর সহ আরো তিনটি গ্রাম ঢেঙ্গাআম, লুহামাইলা ও বরালটা। এই মৌজাগুলির প্রতিটির একজন করে গ্রামপ্রধান পূজার কমিটিতে আছেন। এঁদের মধ্যে প্রধান নির্বাচিত করা হয়েছে (২০১৬) জয়নগরের সমায় মাণ্ডিকে‌। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের যেসব গ্রামের মানুষ এই পাহাড়পূজায় যুক্ত থাকেন সেগুলি হল শিলদা, মধুপুর, সীতাপুর, ঝেঁটাড়া, কেন্দ্রাপাড়া, চুটিয়াভদরি, মুনিয়াদা, খাঁকড়িঝর্ণা, ডুমুরিয়া এবং বাগালপাড়া। এগুলির মধ্যে খাঁকড়িঝর্ণা গ্রামের দেওয়া পাঁঠা প্রথম বলি দেওয়া হয়।
পাহাড়পূজায় এখানে মূলতঃ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ উপচার পালন করেন। আবার মুণ্ডাদের আরাধ্য দেবতা 'সিংবোঙ্গা' আসলে পাহাড় দেবতা। তাঁরা আষাঢ় মাসে কানাইসর পাহাড়ে পাহাড় দেবতার পূজা করলেও মুণ্ডা কিশোরীদের 'কানফোঁড়' অনুষ্ঠান করে ১ লা মাঘ। যা 'টুকাই লুতুর' নামে পরিচিত। বাগাল সম্প্রদায়ের লোকেরা এই ১ লা মাঘ আইখান দিনে পাহাড় পূজা করে। এজন্য তাঁরা উইঢিপি কেটে এনে পাহাড়ের প্রতীক হিসেবে শুদ্ধাচারে পূজা করে ফুল, ফল, সিঁদুর সহ হাঁড়িয়া নিবেদনের সাথে সাথে বলিদানের মাধ্যমে। এঁরা পাহাড়পূজা করে গবাদি পশু যাতে না হারিয়ে যায় এবং রোগাক্রান্ত না হয় এই কামনায়। কালো পাঁঠাবলি দিয়ে সেই পাঁঠা ও খিঁচুড়ি সহযোগে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। এইদিনে মুণ্ডাদের মতো বাগাল কিশোরীদের 'কানফোঁড়' করার উত্তম দিন বলে বিবেচিত। ঐ কিশোরী নতুন কাপড় পরে আলপনা দেওয়া মাটির  মেঝেতে রাখা কাঠের পিঁড়ি 'মারুয়া' তে বসে। আর দেহরীর অনুমতি নিয়ে বেলকাঁটা দিয়ে কানফোঁড় করা হয়। আর একজন ঘরের চালে উঠে পিঠা ছড়ায় সেখানে। ফোঁড় শেষ হলে সেখানে রাখা একটা জ্যান্ত মুরগিকে আছড়ে মেরে ফেলা হয় কিশোরীর মঙ্গল কামনায়। এইদিনে বাগাল সম্প্রদায়ের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে 'জোড়' বা প্রনাম করে।"

"কানাইসর পাহাড়ের নিচে বসে বিশাল মেলা। বিভিন্ন এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন আসেন। অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনও এখন আসছেন। দুদিনের মেলা। প্রথম দিন সকলের জন্য খোলা। দ্বিতীয় দিন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষজন আসেন। মেলায় দেদার বিক্রি হয় কাঁঠাল, জিলিপি, বাদ্যযন্ত্র, পাথরের সামগ্রী থেকে হাঁড়িয়া, মদ, বিয়ার ইত্যাদি। ভাত খাওয়ার হোটেল বসে যায়। বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন এখানে। ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে ওঠে কানাইসর সংলগ্ন এলাকা। 'ঘঙ' পাতার টুপি এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। বারোডাঙা, মালিবনি গ্রামে এগুলো তৈরি হয়। এ এক অন্য ধরনের লৌকিক উৎসব। একটা আস্ত পাহাড় হয়ে ওঠে উপাস্য দেবতা।"

বাংলা দৈনিক সংবাদ পত্র ' একদিন ' পত্রিকায় ৫ ই জুলাই, ২০২২ , স্থানীয় ইতিহাস ,কৃষ্টি ,সংস্কৃতি সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু গবেষক অরূপ ঘোষ মহাশয় 
'বেলপাহাড়িতে কানাইসোর পাহাড় পুজোয় অসংখ্য মানুষের সমাগম' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন এ বলেছেন:
"এই কানাইসোর পাহাড় পুজো অনেক প্রাচীন। মূলত এখানকার আদি জনজাতি বাসিন্দারা চাষবাসের আগে প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করতে এই পাহাড়ের পুজো করে থাকেন। এঁদের লোকবিশ্বাস মতে এই পাহাড় পুজো করলে চাষবাস ভালো হবে। অতিবৃষ্টিতে কেউ বানভাসি হবেনা। হড়কাধান হবে না। তাই চাষবাস শুরু করার আগে কৃষিজীবী সবাই পাহাড়ে পুজো দেন।
বহু বছর আগে এলাকায় প্রবল বন্যায় ঘরবাড়ি, গরামথান বা গ্রাম রক্ষার দেবতা সমস্ত কিছু ভেসে গিয়েছিল। পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী ঢেংগাম গ্রামের বাসিন্দারা সেই সময় পাশাপাশি অন্যান্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে সভা করে তবে গ্রাম রক্ষার দেবতাকে এই পাহাড়ে প্রতিষ্ঠিত করেন সেই সময় থেকেই এই পাহাড়ে ঢেডাম গ্রামের মাহালি সম্প্রদায় পুজারী হিসেবে রয়েছেন। শনিবার এই পাহাড় পুজো অনুষ্ঠিত হয় এই পাহাড় পূজা অনুষ্ঠান দু দিন ধরে চলে। একে কেন্দ্র করে থাকছেন ওখানে মেলা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়-স্বজন ও কুটুম লোকজন ওই এলাকায় হাজির হয়েছেন। অন্যান্য গরামথানে পোড়া মাটির হাতি গড়া মূর্তি উপবিষ্ট করে রাখার মত এই পাহাড়েও সেই মূর্তি রেখে পুজো করা হয়। পুজোয় মুরগি বা ছাগ বলি প্রথা প্রচলিত রয়েছে। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি থেকে এই পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় ৯ কিমি। চাকুলিয়া রেলস্টেশন থেকে এই পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় ১১ কিমি। বিনপুর ২ ব্লকের সোন্দাপাড়া গ্রামপঞ্চায়েতের সীমান্তবর্তী কেন্দাপাড়া রাঙামাটি, ডুমুরিয়া ও সীতাপুর এই গ্রামগুলির একেবারে পাহাড়ের পাশে অবস্থিত। পাহাড় পুজো ঘিরে এখানে বড় আকারের মেলা বসেছে। এই মেলাতে লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমস্ত রকমের বাদ্যযন্ত্র ও কৃষি কাজের নানান সামগ্রী পাওয়া যায়। পাহাড় পুজোর পরের দিন রবিবার পাশেই কেবলমাত্র আদিবাসীদের বারাঘাটে পৃথক পাহাড় পুজো ও আচার অনুষ্ঠান পালিত হয়। আদিবাসীদের নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে । ' বঙ্গাবুরু' বা পাহাড় পুজো পালন করা হয়। তাই রবিবারের আদিবাসীদের পাহাড় পুজোর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শনিবার থেকেই দূর দুরান্ত থেকে লোকজন এই পুজোর জন্য আত্মীয় বাড়িতে এসে থাকছেন।"

আবার, কানাইসর পাহাড় পুজো সম্পর্কে সদ্য প্রকাশিত " মুসাফিরের চোখে ঝাড়গ্রাম " গ্রন্থে ঝাড়গ্রাম জেলার ইতিহাস ,জন জীবন ,কৃষ্টি সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর ভাবে অনুসন্ধিৎসু লেখক অরুণাভ দত্ত লিখেছেন" .. ঝাড়গ্রাম জেলার বেলপাহাড়ি (বিনপুর- ২) ব্লকের একদম শেষ প্রান্তে, ঝাড়খন্ড রাজ্যের গা ঘেঁষে কানাইসর পাহাড়ের পাহাড়পুজো শুধু প্রাচীনই নয় ঐতিহ্যশালী ও বটে। প্রত্যেক বছর আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবার কানাইসর পাহাড়ে অনুষ্ঠিত হয় এই পাহাড় পুজো।"" ..হেঁটে যেতে যেতেই দূর থেকে কানাইসর পাহাড়ের ওপরে অসংখ্য মানুষ দেখতে পাচ্ছি। এতো মানুষ তখনই পাহাড়ের এতো ওপরে উঠে গেছে দেখে অবাক হলাম । পাহাড়ের নীচে যেতেই দেখলাম মেলার মত প্রচুর অস্থায়ী দোকান বসেছে। যেকোনো জায়গায় গেলে এই মেলা দেখতে আমার সব চেয়ে ভালো লাগে। চেনা জিনিস এর সঙ্গে প্রত্যেকবারই অচেনা অজানা বহু নতুন জিনিস চোখে পড়ে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে না জেনে ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। তেলেভাজা, ঘুগনি, চাউমিন, রোল, জিলিপি, বিভিন্ন ধরণের মিষ্টিসহ অসংখ্য খাবারের দোকান। আর একটা জিনিস চোখে পড়ল বরফের আইসক্রীম। কতজন যে বরফের আইসক্রীম বিক্রি করছে তার হিসেবে নেই। এই তীব্র গরমে সেই বরফগোলা আইস ক্রীমের বিক্রিও জবরদস্ত। খাবারের দোকান বাদ দিয়ে আছে পানীয়ের দোকান। পাহাড়পুজো দেখতে আগত দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাতে অসংখ্য দোকান তাদের দেশী বিলেতি পানীয়ের পসার সাজিয়ে বসে আছে। সেই সঙ্গে আছে পানীয়ের চাট। বিভিন্ন ধরণের চাটের গন্ধে মেলা প্রাঙ্গন ম ম করছিল। এ এছাড়া আছে বিভিন্ন জিনিসের দোকান। কি নেই সেখানে সেটাই বলা মুশকিল, বাচ্চাদের খেলনা থেকে শুরু করে, আয়না, লোহার বিভিন্ন জিনিস পত্র, পাখা, ঝুড়ি, প্লাস্টিকের জিনিস, বিভিন্ন ধরণের গ্রাম্য বাদ্যযন্ত্র, কাঠের জিনিস, পাথরের বিভিন্ন জিনিস পত্র, তালিকাটি দীর্ঘ। ঝাড়গ্রামে প্রথম কোনো মেলায় তীর ধনুক বিক্রি করতে দেখলাম।"

সুতরাং কানাইসর পাহাড় এবং এই পাহাড় পূজো কে কেন্দ্র করে যে সব জনশ্রুতি, লোক বিশ্বাস ইত্যাদি ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন গল্পে,গানে ,সাহিত্যে ,উৎসব অনুষ্ঠানে ,তার কোন টি সত্যি আর কোনটি সত্যি নয়, সেই তর্ক দূরে সরিয়ে রাখা ভালো ।বরং এই অঞ্চলের এই পাহাড় এবং পাহাড় পুজো কে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের  মানব গোষ্ঠীর মধ্যে যে সকল  বিবিধ আচার অনুষ্ঠান রীতি নীতি বিশ্বাস   ইত্যাদি জন্ম নিয়েছে ,তার মধ্যে যেমন এই অঞ্চলের বহমান সংস্কৃতির ইতিহাসের  পরিচয় পাওয়া যায় , তেমনই খুব ভালো ভাবে গবেষণা ,পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করলে এই সকল সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির ধারক বাহক দের আদিম ইতিহাসের বিভিন্ন দিক উন্মোচন করা সম্ভব। এমনকি এই পাহাড় পুজো কে কেন্দ্র করে পারিপার্শ্বিক অঞ্চলের জনবসতির আদিম ইতিহাসের অসংখ্য নিদর্শন ও  ইতিহাসে উপাদান খুঁজে বের করা সম্ভব  বলেই প্রতীয়মান হয়।  এবং এই সকল পাহাড় পুজো বহু প্রাচীন , এই পাহাড় পুজো কে কেন্দ্র করে মানুষের আবেগ শ্রদ্ধা,তথা  পূর্ব পুরুষদের প্রতি আধুনিক মানুষের ভালোবাসা , আত্ম নিবেদন ও হার্দিক তর্পণ উপলব্ধি করা যায়।
প্রসঙ্গ ক্রমে  আরো একটি বিষয় অনুমান করা যায়, বর্ষার প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত কানাইসর  তথা অপরাপর পাহাড় পুজোর মিলন উৎসবে মানুষ তার নিজের কাছে সংরক্ষিত আগামী কৃষি কাজের উপযোগী ফসলের বীজ-এর আদান প্রদান তথা বিনিময়ও করত।  হতো কৃষি কাজ সংক্রান্ত বিবিধ অভিজ্ঞ্যতা ও জ্ঞানের আদান প্রদান। কৃষি কাজের উপযোগী পশু ও যন্ত্রপাতির বিনিময় হওয়াটাও অস্বাভাবিক ছিল না।এবং কৃষি ভিত্তিক মানব সভ্যতার গোড়াপত্তন এর এক ধারাবাহিক অকথিত ইতিহাস যে এই উৎসবের পরতে পরতে মিশে আছে , সে কথা বেশ দৃঢ়তার সাথে বলা যায়।

..................সমাপ্ত......................
বিচিত্র গুপ্ত
প্রযত্নে :বিধান দেবনাথ
বেলপাহাড়ী। ঝাড়গ্রাম।
যোগাযোগ নম্বর :৮৯৪৫৮৭৬৭১৯
২৮/৮/২০২৩














Comments

Popular posts from this blog

বেলপাহাড়ীর ঘোরার জায়গা গুলোর লিস্ট

গাড়ি ভাড়া /ঝাড়গ্রাম - বেলপাহাড়ী ট্যুর

বেলপাহাড়ীর হোম স্টে ও রিসোর্ট নাম্বার@ বিচিত্র গুপ্ত