বেলপাহাড়ী ঘুরতে আসার প্ল্যান// বিচিত্র গুপ্ত
বেলপাহাড়ী ঘুরতে আসার সব থেকে ভালো প্ল্যান....
@বিচিত্র গুপ্ত।
ফেসবুক,ইউ টিউব দেখে যদি প্ল্যান করেন , বেল পাহাড়ী গিয়ে কেবল মাত্র কয়েকটি স্পট দেখবো তাহলে পুরোপুরি আনন্দ নাও পেতে পারেন। কয়েকটি স্পট মানে ঘাগরা, তারাফেনি ড্যাম, গাডরাসিনী, খাঁদারানী ড্যাম, লালজল গুহা , কেটকি ঝর্না , ঢাঙিকুসুম ,কাকড়াঝোর ইত্যাদি দেখবো ,একদিন কিংবা দুদিনের মধ্যে আবার বাড়ি ফিরে আসবো ,এমন প্লান করলে সত্যি বলতে একটু হতাশ হতে হবে বৈকি ।ভাবতেই পারেন কিংবা বলতেই পারেন , এ আবার কেমন কথা! কেউ তো এমন কথা বলেন নি?সবাই ওই স্পট গুলো ঘুরে দেখার কথা বলেছেন।তাহলে আমি কেন এমন কথা বলছি? এমন কথা বলার অনেক গুলো কারণ আছে।
কয়েকটি কারণ এখানে অভিজ্ঞ্যতা থেকে উল্লেখ করছি।
১. এখানে যে কয়েকটি জলপ্রপাত রয়েছে সব গুলো বর্ষার জলে পুষ্ট। কোন বছর ভালো বৃষ্টি না হলে এই জলপ্রপাত গুলোর জল ধারা খুব কম থাকে বা একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর পুরো শুকনো হয়ে যায়। ফলে বর্ষা বা বর্ষা শেষে ২/৩ মাসের পর ওই জলপ্রপাত একদম শুকিয়ে যায়।
২. যে কয়েকটি ঝর্না /জলাশয়/লেক/জলাধার/ড্যাম আছে সেই গুলোর পরিপূর্ন সৌন্দর্য নির্ভর করে ওই বর্ষার জলের উপর। ফলে জলপ্রপাত গুলোর মতোই ওই স্পট গুলোর অবস্থা হয়।খুব কম জল থাকে বা একদম শুকিয়ে যায়। ফলে যে কারণে ওই স্পট গুলো তে যাবেন ঠিক করেছেন, বা ভাবছেন ,এসে হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
৩. এর পর থাকলো গাডরাসিনী পাহাড় কিংবা লালজল এর পাহাড়ি প্রাগৈতিহাসিক গুহা। অনেকের পক্ষে ট্রেক করে ওই পাহাড় চুড়া কিংবা গুহা তে উঠে দেখা সম্ভব হয় না।আর উপরে উঠতে না পারলে আসল আনন্দ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
৪. সেই সঙ্গে বেলপাহাড়ী তে থাকা এবং খাওয়ার খরচ তুলনা মূলক ভাবে অন্যান্য পর্যটন ক্ষেত্রে থাকা খাওয়ার খরচের থেকে একটু বেশি।অথবা যে টাকায় অন্য কোন পর্যটন ক্ষেত্রে থেকে যে সকল সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় ,এখানে সেই সকল সুযোগ সুবিধা নাও পাওয়া যেতে পারে।ফলে এখানে অত টাকা খরচ করে এসে ঘুরে ,হতাশ হয়ে যখন মনে হবে, বেলপাহাড়ী তে কই তেমন কিছুই তো দেখার নেই, শুধু আসা টা সার হলো,তখন বেশ হতাশ লাগবে নিজেকে। তখন কি করবেন?
৫. প্রয়োজনের তুলনায় এই খানে ট্যুরিস্ট গাইড কিংবা যথোপযুক্ত ট্যুরিস্ট গাইড ম্যাপ এর অভাব রয়েছে। ফলে গাইড ছাড়া কিংবা কেবল মাত্র গুগল ম্যাপ এর উপর ভরসা করে ঘুরতে গেলে এক পথে বার বার ঘুরপাক খেতে খেতে সময়ের অপচয় হবে। ফলে সারা দিন ঘোরার পর মনে হবে,ধুস এ কোন ফালতু জায়গায় এলাম রে বাবা!
সুতরাং করণীয় কি??তাহলে কি ঘাগরা, তারাফেনি ড্যাম, গাডরাসিনী, খাঁদারানী ড্যাম, লালজল গুহা , কেটকি ঝর্না , ঢাঙিকুসুম ,কাকড়াঝোর ইত্যাদি দেখার জন্যে বেলপাহাড়ী যাবো না??? না ,শুধু মাত্র এই গুলো দেখার প্লান পরিকল্পনা কিংবা মানসিকতা নিয়ে বেলপাহাড়ী এলে একটু হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যাতে এই হতাশা আপনাকে গ্রাস করতে না পারে তবে আমার অভিজ্ঞ্যতা আপনার সাথে শেয়ার করতে পারি।
প্রথম কথা হলো ঝাড়গ্রাম তথা বেলপাহাড়ী আসলে প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। মানে এই অঞ্চলে রয়েছে সুবিস্তৃত শাল মহুয়া কেঁদু পলাশ করম ধ পিয়াল কুড়চি ভুডরু আগুই ইত্যাদি গাছের জঙ্গল। রয়েছে বেলপাহাড়ী অঞ্চলের পুরো অঞ্চল অসংখ্য ছোট বড় পাহাড় টিলা ইত্যাদির অপূর্ব শোভা।রয়েছে পাহাড়ের কোলে জঙ্গলের মধ্যে অসংখ্য প্রাচীন ছবির মত জনপদ।রয়েছে জংলী পাহাড়ী লাল মোরামের সর্পিল পথ।রয়েছে চিড়াকুটি, আগুইবিল, কেন্দাপাড়া,জামাইমারী, তারাফেনী , চাকাডোবা ,কাকড়াঝর ,বেলপাহাড়ী , সিলদা র গ্রামীণ হাট।এখানে রয়েছে রং বেরঙের প্রায় তিন শত এর অধিক পাখি। রয়েছে বন ময়ূর , বন মোরগ , কাঠবিড়ালি, প্রজাপতি ,বুনো ব্যাঙ , বুনো খরগোশ ।
সেই সঙ্গে বেলপাহাড়ি র আনাচে কানাচে রয়েছেন আবহমান ইতিহাসের অসংখ্য নিদর্শন।রয়েছে সেই সব প্রাচীন গ্রাম যে সকল গ্রাম থেকে প্রাগৈতিহাসিক অসংখ্য প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে। যেমন তামাজুরি গ্রাম থেকে পাওয়া গেছে তাম্র যুগে মানুষের ব্যবহার করা তামার কুঠার, লালজল, পাটাঘর, বরহাপাল, আশরি, কাঠতারা , ওরলী , ধুলিয়াপুর ইত্যাদি গ্রাম থেকে পাওয়া গেছে নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের ব্যাবহার করা অসংখ্য নিদর্শন। রয়েছে নীল কুঠী,নীল খারখানা ,নীলকর সাহেব দের সদর অফিস বা বাংলো। বাংলা সিনেমার অসংখ্য শুটিং স্পট এই অঞ্চলের বিবিধ জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । রয়েছে প্রায় ১২/১৩ রকম স্থানীয় নৃত্য।রয়েছে স্থানীয় সঙ্গীত এর ভান্ডার। রয়েছে সাঁওতালি ,ভূমিজ, কুড়মালি,সুবর্ন রৈখিক ,বাংলা,ঝাড়খণ্ড এর ভাষাভাষী অসংখ্য মানুষ।
আপনি বলতে পারেন, এই সব না হয় বুঝলাম।কিন্তু বেলপাহাড়ী যাবো তো ঠিক করেছি, কিন্তু কেন যাবো?কি দেখার জন্যে যাবো??
আসুন , কেবল মাত্র প্রকৃতি ,প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য , প্রকৃতির অনির্বচনীয় রূপ দেখতে ,রূপ দেখে মোহিত হতে, প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে , প্রকৃতির সাথে নিজেকে একাত্ম করতে , "আজকে আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা" গান ঠোটে বিড়বিড় করতে করতে সত্যি সত্যি হারিয়ে যেতে, শহুরে জীবনের এক ঘেঁয়ে রুটিন ,দম বন্ধ অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নির্মল বিশুদ্ধ শাল মহুয়া কেন্দু এর ছোঁয়া লাগা বাতাসে নব প্রাণে সিক্ত হওয়ার জন্যে বেলপাহাড়ী ঝাড়গ্রামে আসুন।পাহাড়ি জংলী আঁকা বাঁকা পথ ধরে কিংবা কোন গ্রামের মোড়াম রাস্তা ধরে সকালে কিংবা পড়ন্ত বিকেলে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবার জন্যে বেল পাহাড়ী আসুন। আসুন কোন শ্বেত পাথরের টিলার উপর বিকেল বেলা অসংখ্য পাহাড় চূড়ার সমারোহের মধ্যে লাল টকটকে সূর্যের অস্ত যাওয়ার অপরূপ শোভা উপভোগ করার জন্যে ।কিংবা চাঁদনী রাতে তার হাতে হাত রেখে প্রকৃতির নিস্তব্ধতার মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার জন্যে নির্দ্বিধায় আসতে পারেন। বনের মধ্যে কিংবা বড় কোন মহুয়া তেতুঁল গাছের ছায়ায় কোন পাথরের উপর চুপ চাপ বসে নির্জন দুপুরে পাখির গান শোনার জন্যে ,পাখির গান শুনতে শুনতে নিজে মনে মনে পাখির মতন ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার জন্যে এখানে আসুন।গাছ দেখতে ,এক একটি গাছের অপূর্ব ভাস্কর্য উপভোগ করতে ,শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি নিজের হৃদয়ের উপত্যকায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করতে আসুন। বর্ষায় আসুন,গ্রীষ্মে আসুন,শীত ,বসন্ত কিংবা শরতে আসুন। এই বাংলার ছয়টি ঋতুর পৃথক পৃথক রূপ রস গন্ধ বর্ন উপভোগ করার জন্যে। আপনাকে পেয়ে এই অঞ্চলের প্রকৃতি তার নিজেকে সম্পূর্ন উজাড় করে আপনাকে ঢেলে দেবে ভালোবাসা প্রেমের আলিঙ্গনে। আসুন ,হতে সময় নিয়ে, নিজের সকল কর্ম ব্যস্ততা ,হতাশা ,গ্লানি দূরে ফেলে দিয়ে প্রকৃতির ডাকে প্রকৃতির কোলে নিজেকে উজাড় করে দিতে ,একাত্ম হতে আসুন।
গাছে বিশেষ করে মহুয়া কিংবা কেন্দূ গাছে রয়েছে প্রায় ৩০/৩৫ রকমের অর্কিড। বছরের বিবিধ সময় তাতে ফোটে রং বেরঙের ফুল। বসন্তে ফোটে পলাশ শাল মহুয়া। সঙ্গে নাম না জানা কত বুনো ফুল।সেই সব ফুল ও ফুলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখতে আসুন বেলপাহাড়ি।
রয়েছে অসংখ্য পাহাড়ি উপত্যকা। হিমালয় এর মতই।কিংবা ভারতের অসংখ্য বিখ্যাত ভ্যালি এর মতোই রয়েছে অসংখ্য ভ্যালি।যেমন অদলচুয়া মাজগেরিয়া ভ্যালি, ধোবাকাচা- বাঁশপাহাড়ি - সিংহা ডুবা ভ্যালি, গজপাথর - তুলসীবনি - মহুল বনী ভ্যালি । লাবনী - পাথর চাকরি ভ্যালি ইত্যাদি। এই গুলোর অপরূপ উল্টানো সড়ার মত উপত্যকা আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
কেবল মাত্র আপনাকে অত উচু গাডরাসিনী পাহাড়ের চূড়ায় কষ্ট করে উঠে প্রকৃতি দেখতে হবে এমন কোন কথা নেই।আপনি এই অঞ্চলের যে কোন টিলা বা পাহাড়ে উঠে প্রকৃতি দেখতেই পারেন। আপনি সিধ্যান্ত নিলে যেকোন পাহাড়ে ওঠার কোন না কোন পাহাড়ি পায়ে চলা পথ আপনি পেয়ে যাবেন।সুতরাং পাহাড় চূডায় উঠে প্রকৃতি দেখতে কোন অসুবিধা নেই । একদম ঢালু (খাড়া নয় এমন পাহাড়) পাহাড় রয়েছে।যেগুলো তে অনায়াসে উঠে যাওয়া যায়।
দরকার হলে যে কোন পথে আপনি চাইলে ঘুরতে যেতে পারেন।যেকোন পথ।সেই পথের দু পাশের সৌন্দর্য আপনি দুই চোখ ভরে উপভোগ করতে পারেন। নাহয় ওই পথে ঘুরতে ঘুরতে পথ হারালেন।কিন্তু আপনি তো জানেন দিন শেষে কোথায় ফিরতে হবে।সুতরাং যেকোন মানুষ কে জিজ্ঞেস করুন আপনার ফেরার পথ বলে দেবে।
সুতরাং নির্দিষ্ট কয়েকটি স্পট দেখতে আসার পরিকল্পনা থেকে নিজেকে বিরত রেখে ,কেবল মাত্র " প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র " বেলপাহাড়ী তে প্রকৃতির ডাকে প্রকৃতি কে উপভোগ করতে ,প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে আসুন। এইখান কার বিচিত্র প্রাকৃতিক শোভা আপনাকে একদম নিরাশ করবে না। এই টুকু নিশ্চিত।
কিছু সতর্কতা: ১. এই অঞ্চলে অসংখ্য যুব জন্তু আছে ,তাদের কে কোন রকম বিরক্ত করা থেকে নিজেকে সংযত রাখতে হবে।
২. গ্রাম ,গ্রামের মানুষ ,তাদের ভাষা সংস্কৃতি ,জীবন যাপন কোন ভাবে যাতে আঘাত প্রাপ্ত না হয় সেদিকে সচেতন থাকতে হবে।
৩. কোথায় ঘুরতে গেলে যেখানে থাকবেন সেখান কর কতৃপক্ষের সাথে অবশ্যয় একটু পরামর্শ করে নেবেন।
৪. অযথা যত্র তত্র প্লাস্টিক এর প্যাকেট বোতল ইত্যাদি ফেলে পরিবেশ এর ভারসাম্য নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. স্থানীয় প্রশাসন এর অনুমতি ছাড়া গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করা ,ড্রোন ব্যবহার করে ছবি তলা থেকে বিরত থাকা ভালো।
৬. প্রয়োজনে আপনি আপনার প্ল্যান তৈরির সময় নিচের ব্যক্তি দের সাথে পরামর্শ করে নিতে পারেন
ক) মধুসূদন কর্মকার +919800635760
খ) বিধান দেবনাথ +91894876719
Comments