### ঘাগরার গল্প ###@ দেবাশীষ রায়

### ঘাগরার গল্প ###

@ দেবাশীষ রায়

রোজকার জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে আমাদের একদিনের বাইক অভিযান গুলো ভীষণ কাজ দেয়। প্রায় মাস দুয়েক কোথাও যাওয়া হয়নি, মনের মধ্যে একটা ছটফটানি অনুভব করছি, আর নয়, এবারে বেরোতেই হবে। রাত্রে, ক্লাবে ক্যারম খেলতে খেলতে তারই পরিকল্পনা যখন চলছে, ঠিক তখনই আমাদের ভাতৃস্থানীয় ভোলা গুগলদেবের শরণাপন্ন হয়ে আমাদের বললো 'এবারে বেলপাহাড়ির, ঘাগরা ঘুরে এসো'। গুগলে ঘাগরার কয়েকটি ছবি দেখে মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের মত গার্হস্থ্য ভবঘুরের দল এক পায়ে খাড়া হয়ে গেলাম ঘাগরা যাবার জন্য।

দশই আগস্ট 2017 ভোর পাঁচটায়, পাঁচটা বাইকে আমরা দশজন হাওড়ার বাগনান থেকে যাত্রা শুরু করলাম। ঘাগরা যেতে গেলে পাড়ি দিতে হবে একশো ষাট কিলোমিটার রাস্তা। হাইওয়েতে উঠে কোলাঘাটে পৌঁছে গরম এক কাপ করে চা খেয়ে, একটু আড্ডা মেরে আবার চলা শুরু করলাম। মাঝে তিন চারবার দাঁড়িয়ে, খড়গপুর চৌরাস্তা পৌঁছলাম। ওখান থেকে ঝাড়গ্রামের রাস্তা ধরে লোধাশুলি মোড়ে যখন পৌঁছলাম, তখন বাজে সকাল সাড়ে সাতটা।

ওখানে রাস্তার ধারের অস্থায়ী দোকান থেকে দুটো করে গরম গরম কচুরি, অল্প ঘুগনি মুড়ি, গরম আলুর চপ, ডিম ভাজা সব মিলিয়ে মিশিয়ে প্রাতঃরাশ পর্ব মিটিয়ে, এক ভাঁড় করে চা খেয়ে আবার রওনা দিলাম। আপনার মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, দুটো কচুরির পরে আবার মুড়ি কেন রে বাবা !! আসলে ওখানের গরম গরম কচুরির লোভ সামলানো দায়, সবাই পাঁচ ছটা করে খেয়েই নেবে। সকাল সকাল পেট ভরে কচুরি খেয়ে শরীর খারাপ করার ভয়ে, কচুরির ওপর মুড়ি চাপা দিয়ে সুস্থ থাকার এক অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলতে পারেন আর কি। 

এরপর হাইওয়ে ছেড়ে ডানদিকে ঝাড়গ্রামের রাস্তা ধরলাম। এই রাস্তার বড়ই সুন্দর রূপ। দুদিকে শাল গাছের জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এরপর দু এক জায়গায় অল্প সময়ের বিরতি নিয়ে বিনপুর, শিলদা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বেলপাহাড়ী। ওখানে একটা তিনমাথা মোড়ে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ডানদিকের একটা সরু পাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। জনমানবহীন ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলেছে। আরও বেশ কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর উল্টোদিক থেকে দুটো মোষ সঙ্গে নিয়ে হেঁটে আসা একজন স্থানীয় মানুষকে দেখতে পেয়ে, বাইক দাঁড় করালাম। ওনাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যথারীতি ঘাগরা ঢোকার লালমাটির রাস্তাটা ভুল করে এগিয়ে এসেছি প্রায় এক কিলোমিটার মত। বাকি চারটে বাইক তখন ফাঁকা রাস্তায় মনের আনন্দে অনেকদুর এগিয়ে গেছে। ফোন করতে থাকলাম, কেউই ধরছে না। শেষ পর্যন্ত বিশ্বজিৎ ফোন ধরে জানালো ওদেরও চৈতন্যের উদয় হয়েছে, ফিরে আসছে।

আমরা বাইক ঘুরিয়ে লাল মাটির রাস্তাটার কাছে পৌঁছে ওই রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম। দুদিকে বড় বড় গাছের ফাঁকে কিছু দুরে দুরে এক আধটা মাটির বাড়ি চোখে পড়ছে। বোঝাই যাচ্ছে একটা ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলেছি। আরও কিছুটা যাওয়ার পর বামদিকে বেশ বড় সাইজের ঘাগরা লেখা বোর্ডটা চোখে পড়তে বুঝলাম পৌঁছে গেছি। সামনে রাস্তা আর নেই, অনেকটা জায়গা জুড়ে বালির ওপর ছোট বড় গোলাকৃতি নুড়ি পাথর পড়ে আছে । ঠিক যেমনটা ডুয়ার্সের জয়ন্তী নদীর ধারে দেখা যায়। আমরা যেখানে এসে থামলাম এই জায়গাটা অনেক গুলি বড় গাছের ছায়ার জন্য বেশ আরামপ্রদ। আজ আবহাওয়া ভীষণ গুমোট, বেশ গরম লাগছে। ঘড়িতে সাড়ে নটা বাজে, এত তাড়াতাড়ি আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি দেখে ভালো লাগলো। রাস্তাটা ছেড়ে ডানদিকে গাছের ছায়ায় বাইকটা স্ট্যান্ড করলাম।

তারপরে বামদিকে ঘাগরা লেখা বোর্ডের পাশ দিয়ে একটু এগোতেই গাছের আড়ালে থাকা ঘাগরা ফলস এর দেখা মিললো। আশেপাশের দৃশ্য দেখে দারুন এক ভাললাগায় মনটা ভরে গেল। সামনে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এলোমেলো প্রকান্ড সাইজের পাথরের স্তুপ। অনেকটা দুরে বামদিকে জঙ্গল ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে যেন পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। পাথরের মাঝখান থেকে চঞ্চল জলধারা বয়ে এসে সামনে ছোট নদীর আকার নিয়ে বয়ে গেছে। ভালোই স্রোত আছে দেখলাম। প্রকৃতির কি অদ্ভুত খেয়ালে এই বড় বড় পাথরের গায়ে বেশ কিছু ছোট বড় গোল গোল গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, দেখলে মনে হবে নিখুঁত হাতে ড্রিল করে বানানো, গর্তগুলোর মুখের মাপ একটা টেনিসবলের থেকে একটু বড়। এই পাথরের গায়ের গর্ত গুলোর পোশাকি নাম 'পটহোল'। এই জায়গাটায় পৌঁছেই অবিরাম জলস্রোতের শব্দ কানে আসছিল। সেই শব্দ লক্ষ করে বামদিকে পাথরের ওপর দিয়ে সাবধানে পা ফেলে এগোতে থাকলাম। দেখলাম পাথরের সরু খাঁজের মধ্যে দিয়ে প্রবল বেগে জল আসার সময় এই শব্দের সৃষ্টি। তবে এর নাম ফলস হলেও এটা এমন একটা ফলস যেটার ওপর দিয়ে আপনি অনায়াসে টপকে যেতে পারবেন।

আমিও টপকে অপর পারে পৌঁছে গেলাম। পুরো জায়গাটাই বড় বড় পাথরের স্তুপ। একটু ওপরে উঠে ডানদিকে ঘুরতেই ঘাগরাসিনি দেবীর আরাধ্য স্থানটি চোখে পড়লো। অনেক ছোট বড় সাইজের পোড়ামাটির পুতুল ঘোড়া এলোমেলো রাখা আছে। কিছু মাটির প্রদীপ আর ধুনুচিও দেখলাম, কিন্তু কোন পাথরখণ্ড বা বিগ্রহ চোখে পড়লো না। পুরো জায়গাটিই বড় বড় গাছে ঘেরা। পাথরের ফাঁকফোকর দিয়ে শিকড় চালিয়ে সদর্পে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোকে দেখলেই মনে হয় সৃষ্টিকে সত্যিই আটকে রাখা যায়না। দেবীর স্থানের পাশে একটু নিচের দিকে একটা বড়, চওড়া প্রায় সমতল পাথরের ওপর আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। আশেপাশে বড় বড় গাছের ছায়ার জন্য জায়গাটা বেশ ঠান্ডা। গরমের মধ্যে এই প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। আমার বাইকের সহযাত্রী রাজাদা তখন ক্যামেরা নিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেছে ছবি তুলতে তুলতে। একটু পরেই বাকি চারটি বাইক এসে পড়লো, আর আটজন নেমে এদিক ওদিক কিছুক্ষন লম্ফঝম্ফ করে গরমের থেকে মুক্তি পেতে আমার সদ্য তৈরি আস্তানায় আশ্রয় নিলো। জামা, জুতো খুলে সবাই আরাম করে আড্ডা দিতে বসে পড়লো।

প্রায় আধঘন্টা আড্ডা মারার পরে উত্তমকে গ্রামে গিয়ে কারও বাড়িতে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখতে বললাম। উত্তম নিজের বাইক নিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেল। পাথরের চাতালের ওপরে আমাদের আড্ডাটা বেশ জমে উঠলো। পরিবেশটা গুমোট হয়ে আছে, আকাশে মেঘ আছে, যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আরও প্রায় মিনিট চল্লিশেক কেটে গেল উত্তমকুমারের পাত্তা নেই। ওকে গ্রামে বেঁধে রেখেছে কিনা এইসব নিয়ে খুব হাসাহাসি চললো। বেগতিক দেখে আমি যাব কিনা ভাবছি এমন সময় উত্তম সঙ্গে একটি ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাইক রাখার জায়গায় হাজির হয়ে আমাদের ডাকলো। আমরা কয়েকজন আবার পাথর টপকে ওই পারে গিয়ে পৌঁছলাম। 

সঙ্গের কম বয়সী আদিবাসী ছেলেটিকে দেখিয়ে উত্তম বললো এই ভাই আজ আমাদের রান্না করে খাওয়াবে, ওর নাম ধনঞ্জয় মান্ডি, ঘাগরা ফলসে আসার রাস্তায় শেষ বামহাতের বাড়িটাই ওদের। গ্রামে কোনও বাড়িতে লোকজন বিশেষ কেউ নেই, সবাই কাজে বেরিয়ে গেছেন। ওর বাড়িতে খুব ছোট একটি বাচ্চা আছে বলে ও বাড়িতে আছে। মাংস ভাত রান্না করে দেবে, কিন্তু ওকে একটা বাইক দিতে হবে, বাজার করতে যাবে তার সঙ্গে ওর মামার বাড়িতে কিছু একটা দরকার আছে সেটাও মিটিয়ে আসবে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে উত্তমের বাইক আর নশো টাকা দিয়ে দিলাম। আমাদের দশজন আর ওর বাড়ির তিনজনের একসাথে রান্না করার কথাও বলে দিলাম। যাওয়ার আগে ধনঞ্জয় সাবধান করে দিয়ে গেল, ঘাগরাসিনী দেবীর বেদিতে জুতো পরে ওঠা নিষেধ, আর কোনোরকম নেশাভাঙ করাও নিষেধ। আশেপাশের মানুষ ভীষণ শ্রদ্ধা করেন এই দেবীকে। আমরা এইরকম কিছুই করবো না বলাতে সে নিশ্চিন্তে বাইক নিয়ে চলে গেল। 

আমি আবার ফিরে এসে একটা ব্যাগ মাথায় দিয়ে ওই পাথরের ওপর শুয়ে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। আগের দিন রাত্রে আমি একটুও ঘুমোতে পারিনি, তাই আধঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলেও অনেকটা এনার্জি পাওয়া যাবে। এদিকে এরা সবাই বেশ কিছুক্ষন আড্ডা মারার পর স্নান করতে নামার তোড়জোড় শুরু করলো। এইসময় আবিষ্কার হলো যে কেউই শ্যাম্পু বা সাবান সঙ্গে নেয়নি। সবাই জামা প্যান্ট ছেড়ে গামছা পরে ফেলেছে। আমিই একমাত্র তখনও জামা,প্যান্ট পরে আছি, স্বাভাবিক ভাবেই শ্যাম্পু সাবান কিনতে আমাকেই যেতে হলো। আবার সেই গাছতলা থেকে বাইক বের করে গ্রামের লালমাটির রাস্তা পেরিয়ে পাকা রাস্তার ওপর একটি ছিটেবেড়া দোকান থেকে কয়েকটা শ্যাম্পুর পাউচ প্যাকেট আর দশ টাকা দামের দুটো সাবান কিনে, ধনঞ্জয়ের বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরে রান্নার খবরাখবর নিয়ে ফিরে এলাম। 

ততক্ষণে রাজাদা আর আমি ছাড়া সবাই জলে নেমে পড়েছে, আমিও গামছা পরে ওদের সঙ্গে যোগ দিতে এগিয়ে গেলাম। নামার আগেই বাকিরা সাবধান করলো নীচে ধারালো পাথর আছে, ভুলভাল হাত পা ছুঁড়লে চোট লেগে যাবে। যাইহোক, সাবধানে নেমে পড়লাম। ঠান্ডা জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দারুন আরামবোধ করতে লাগলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক ওই এক গলা জলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডাবাজি চললো। এর মাঝে একটি সাদা রঙের স্কর্পিও গাড়ি এসে সামনের খোলা জায়গাটায় থামলো, আমরা ভাবলাম কোনও ট্যুরিস্ট হবে। কিন্তু দেখলাম একজন অফিসার আর সাতজন স্বশস্ত্র জওয়ান নামলেন গাড়ি থেকে। ওনারা পাথরের ওপর দিয়ে ফলস এর কাছে গেলেন, একটু ঘোরাঘুরি করলেন। কেউ কেউ মোবাইল বের করে ছবি তুললেন। আমরা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। রাজাদা তখনও জলে নামেনি, ভরসা করে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ওনারা বললেন রুটিন টহল, আপনাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমাদের ঠিক বিশ্বাস হলো না। আমরা ভাবলাম, দশটি ছেলে বাইকে চড়ে এলাকায় ঢুকেছে, এই খবর পেয়ে ওনারা ব্যাপারটা বুঝতে এসেছিলেন, মানে এইদিকে মাওবাদী এক্টিভিটিস হয়তো এখনও কিছু রয়ে গেছে। ওনারা যেমন হঠাৎ এসেছিলেন তেমনই চলে গেলেন। রাজাদা প্রথম থেকেই স্নান করবে না বলছিল, শেষে সেও নেমে পড়লো। এরপর স্নানপর্ব মিটিয়ে, জামাকাপড় পরে আমরা আবার সেই ছায়া জায়গায় গিয়ে বসলাম, আমি অবশ্য শুয়ে পড়লাম। মিনিট দশেক চোখ বুজিয়েছি, হঠাৎ ছোট ছোট ফোঁটার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে ব্যাগপত্র নিয়ে পাথর ডিঙিয়ে উল্টোদিকের বড় গাছগুলোর তলায় এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টিটা চমক দিয়ে যেমন এসেছিল, তেমনই চলে গেল, মাঝখান থেকে আমার কত শখের ঘুমটার সাড়ে সব্বোনাশ করে ছাড়লো। 

আবার আগের জায়গায় ফিরে গিয়ে বসবো কিনা ভাবছি ঠিক সেইসময় সাইকেলের পিছনে লালকাপড় মোড়া একটি ঘুগনির হাঁড়ি বেঁধে গ্রামের এক ঘুগনিওলাকে আসতে দেখেই আমরা তার পথ আটকালাম। সেই সকালের কচুরি, মুড়ি অনেকক্ষন আগেই জবাব দিয়ে দিয়েছে। সবাই মিলে শুরু হলো ঘুগনি খাওয়া। থার্মোকলের প্লেটে সবাই দুতিন বার করে ঘুগনি খাওয়ার পর আমাদের কেউ একজন ঘুগনি কাকার সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো ব্যাগ থেকে পাউরুটি উঁকি মারছে এটা আবিষ্কার করলো। ব্যাস নিমেষের মধ্যে হাতে হাতে সমস্ত পাউরুটি ব্যাগের বাইরে এসে উপস্থিত হলো। গুনে দেখা গেল ছোট সাইজের স্লাইস রুটি মোট সাত প্যাকেট আছে। ঐগুলোই সবাই ভাগ করে আরও একরাউন্ড ঘুগনি সহযোগে উদরস্ত করলাম। খিদে যেন কিছুটা মিটলো। মনে হলো ওই খিদের সময় মা ঘাগরাসিনি দেবী যেন আমাদের জন্য ঘুগনিওয়ালা কাকাকে পাঠালেন। 

এইসব কান্ডকারখানা চলতে চলতে ঘড়িতে দেখলাম বেলা একটা বাজে। এবারে সবাই মিলে ওখান থেকে বাইক নিয়ে ধনঞ্জয়ের বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। কথা বলে জানলাম রান্না হতে আরও একটু দেরি আছে। আমরা বসে না থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে তারাফেনী ড্যাম দেখতে চলে গেলাম। সুন্দর গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে পৌঁছে গেলাম তারাফেনী ড্যামের সামনে। ছোটখাট, প্রাকৃতিক ড্যাম, তারাফেনী নদীর জল আটকে রাখা হয়। দেখলাম জল ছাড়া হচ্ছে, আমরা ড্যামের পাশের একটা পায়ে চলা পথ দিয়ে জল ছাড়া দেখতে নেমে গেলাম। স্থানীয় লোকজনের মুখে শুনলাম এই জল মেদিনীপুর ক্যানেলে পাঠানো হয়। ড্যামের আশেপাশের জায়গাগুলো খুব সুন্দর। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। আসার সময় খেয়াল করেছিলাম ড্যামের কিছুটা আগে একটা ছোট আর্মি ক্যাম্প আছে। ফেরার সময় প্রায় পনেরজন জওয়ানকে দেখলাম অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে লাইন করে রাস্তা দিয়ে টহলের ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য এর আগে জগদলপুর থেকে চিত্রকোট জলপ্রপাত দেখতে যাওয়ার রাস্তায় জঙ্গলের মধ্যে দেখেছিলাম। আমাদের আগের ধারণা আরও বদ্ধমূল হল, ওই এলাকায় কিছু গোলমাল আছেই। 

আমরা কিছুক্ষন পরে ধনঞ্জয়ের বাড়িতে পৌঁছে, ওর উঠোনে রাখা দুটো দড়ির খাটিয়ায় বসে আড্ডা জমালাম। আর একটু অপেক্ষার পরেই আমাদের খাওয়ার ডাক পড়লো। লম্বা বারান্দায় নাইলনের টানা আসন পেতে সবার বসার জায়গা করা হয়েছে। থার্মোকলের পাতায় ভাত, একটা টকঝাল টমেটোর চাটনি যেটাতে আবার পেঁয়াজও দেওয়া আছে, আর থার্মোকলের প্লেটে আলু আর মাংসের পাতলা হলুদ রঙের ঝোল। ঝোলটা দেখে বুঝতে পারিনি যে কাঁচালঙ্কা দিয়ে রান্না মাংসের পাতলা ঝোল কতটা সুস্বাদু হতে পারে। ধনঞ্জয় আর ওর গিন্নি আমাদের খুব আন্তরিকতার সঙ্গে পরিবেশন করলো। খুব তৃপ্তি করে খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম। ধনঞ্জয় বার বার বলতে লাগলো আপনারা যেমন রান্নাবান্না খান সেরকম কি আর আমরা পারবো। আমরা অনেকবার বললাম যে রান্না খুব সুন্দর হয়েছে, কিন্তু সে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। বললাম, সবথেকে বড় কথা কজনই বা এরকম ভাবে অচেনা অজানা দশজন ছেলেকে নিজের বাড়িতে রান্না করে খাওয়াবে ? এটা কোন ব্যাপারই নয় এরকম একটা মুখ করে সে হেসেই উড়িয়ে দিল আমাদের কথা।

এরপর আবার বেশ কিছুক্ষণ দড়ির খাটিয়ায় বসে আড্ডা দিতে দিতে রেস্ট হয়ে গেল। এরমধ্যে ধনঞ্জয় খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমাদের কাছে আড্ডা দিতে এলো। কথায় কথায় জানলাম কত কষ্ট করে এইসব এলাকার মানুষেরা বেঁচে আছে। অল্পস্বল্প জমি যাদের আছে তারা চাষবাস করে, তাতে কোনরকম সারাবছর চালের বন্দোবস্ত হয়। বাড়ির ছেলেরা বাইরে কাজে যায়। এলাকায় তেমন কোনও কাজের সুযোগ নেই। এককথায় ভীষণ কঠিন জীবন কিন্তু মুখে হাসির খামতি নেই। এরা লড়াই করতে জানে, খুব অল্পতেই খুশি থাকতে জানে। আর আমরা অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা পাওয়া সত্বেও নানারকম অভাব অভিযোগ করতেই ব্যস্ত। ধনঞ্জয় কথা দিয়েছে ওই এলাকায় কেউ যদি বাইরে থেকে ঘুরতে যান তা হলে সে যেভাবে পারবে সাহায্য করবে। এবার আমাদের ওঠার পালা, ধনঞ্জয়কে আরও কিছু টাকা জোর করে দিয়ে ওর বাড়ির সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। রাস্তায় বেশ কয়েকবার চা খেয়ে আড্ডা মারতে মারতে রাত্রি নটার সময় বাগনান ফিরলাম। মাঝে অনেকগুলো দিন কেটে গেছে, কিন্তু ধনঞ্জয়, ঘাগরা এসব অমলিন স্মৃতি হয়ে মনের মণিকোঠায় রয়ে গেছে। আবার কোনদিন দুম করে গিয়ে হাজির হয়ে যাব সেই কাঁচালঙ্কা দেওয়া মাংসের ঝোল এর স্বাদ নিতে। জানি না লিখে আপনাদের কতটা বোঝাতে পারলাম, ভালমন্দ কেমন লাগলো যদি একটু মন্তব্য করেন তা হলে খুব খুশি হবো। এত বড় লেখাটা ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানালাম।

https://m.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/2111704248881771/?mibextid=2JQ9oc

Comments

Popular posts from this blog

বেলপাহাড়ীর ঘোরার জায়গা গুলোর লিস্ট

গাড়ি ভাড়া /ঝাড়গ্রাম - বেলপাহাড়ী ট্যুর

বেলপাহাড়ীর হোম স্টে ও রিসোর্ট নাম্বার@ বিচিত্র গুপ্ত