একদিনে বেল পাহাড়ীর কোথায় ঘুরবেন// বিচিত্র গুপ্ত
বেলপাহাড়ী ভ্রমণ গাইড// বিচিত্র গুপ্ত
অধুনা ঝাড়গ্রাম জেলার অন্যতম প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও পর্যটন কেন্দ্র বেলপাহাড়ী। সেই সঙ্গে প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকে বর্তমান মানব সভ্যতার বিবর্তনের বিবিধ পর্যায়ের সাক্ষ্য বহনকারীও এই বেলপাহাড়ী। ঝাড়গ্রাম হয়ে এক দিনের জন্য বেলপাহাড়ী ঘুরে যে সব পর্যটন স্থান পরিদর্শন করা সম্ভব তার একটি সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ গাইড এখানে উল্লেখ করা হল,বিশেষ করে যারা প্রথম বারের জন্যে বেলপাহাড়ী আসবেন ভাবছেন তাদের জন্যে।
কোন কোন জায়গায় যাবেন:-
১. লালজল গুহা
২. ময়ূর ঝর্ণা
৩. কাঁকড়াঝোর
৪. কেটকি ঝর্ণা
৫. ঢাঙ্গিকুসুম হুদহুদী (নাম মোটেই ডুঙরি ফলস নয়) জলপ্রপাত
৬. গাররাসিনি পাহাড়
৭.খান্দারানী জলাধার
৮. তারাফেনী ড্যাম
৯. ঘাগরা জলপ্রপাত।
প্লান:-
সকাল ৯ -১০ টার মধ্যে বেলপাহাড়ী পৌঁছতে পারলে ভালো হয়। মোটামুটি সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫ টা।এক্ষেত্রে দুই পার্টে আপনার ভ্রমণ ভাগ করে নিন। প্রথম পার্ট লাঞ্চ এর আগে।দ্বিতীয় পার্ট লাঞ্চ এর পরে। উপরের লিস্ট থেকে ১ - ৫ নং(লালজল,ময়ূর ঝর্ণা,কাঁকড়া ঝোর, কেটকি ঝর্ণা ও হুদহুদী জলপ্রপাত) পর্যন্ত লাঞ্চ এর আগে। ৬-৯ ( গাররাসিনি, খান্দারানী, তারাফেনী ড্যাম ও ঘাগরা)লাঞ্চ এর পরে। এই দু পার্টে ভাগ করে নিম্নলিখিত পথ বরাবর যাত্রা করলে আপনাকে একই পথে বার বার ঘুরপাক খেতে হবে না।
পথ নির্দেশ : (লাঞ্চ এর আগে)
১. লালজল গুহা :
বেলপাহাড়ী ইন্দিরা চক ( বেলপাহাড়ী প্রবেশ করে পথের ডান দিকে প্রথমে পড়বে ইলেক্ট্রিক পাওয়ার হাউস, তার পর বাম দিকে মুড়ান শোল প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেলপাহাড়ী মার্কেট , বেলপাহাড়ী থানা বাম দিকে, বিডিও অফিস ডান দিকে , তারপরই ইন্দিরা চক) থেকে ঝাড়গ্রাম পিছনে রেখে ৫ নং রাজ্য সড়ক ধরে মোটামুটি ১৫ কিমি গেলে জামতলগোড়া গ্রাম।ডান দিকে CRPF ক্যাম্প। এর পর রাস্তা অনেক টা উঁচুতে উঠে গেছে।এটা কে সিয়ারবিন্দা আপ বলে।আর ২ কিমি এগিয়ে যেতে হবে।এক সময় ওই রাস্তা নিচের দিকে নামবে। নীচে নেমেই ডান দিকে বিশাল বড় শিমুল গাছ,বাম দিকে একটি যাত্রী প্রতীক্ষালয়। এর সামনে দিয়ে ডান দিকে প্রথম যে রাস্তা ,সেই রাস্তা বরাবর ২ কিমি গেলেই বাম দিকে পরবে লালজল গুহা।
(বোঝার সুবিধার জন্য ,বেলপাহাড়ী পাড় হওয়ার পর পথে প্রধান প্রধান যে গ্রাম গুলো আপনাকে পার করতে হবে ,সেই গুলো হল
কুলডিহা, সিঁধুরিয়া, দোমোহানি, ভুলাভেদা, তামাজুড়ি, যাতিহারা, মাজুগোড়া, জামতলগোড়া)
২. ময়ূরঝর্না:
লালজল গুহা দেখে একই পথে ফিরে আবার ৫ নং রাজ্য সড়ক, সড়ক বরাবর ডান দিকে (বেলপাহাড়ী কে পিছনে রেখে) মোটামুটি ৩-৪ কিমি (সিয়ারবিন্দা গ্রাম পার হয়ে) গেলে মূল রাস্তা বাম দিকে বেঁকে ২০০ মিটার গিয়ে আবার ডান দিকে বেঁকে ঝিলিমিলি এর দিকে চলে গেছে।এই জায়গার নাম চাকাডোবা। দ্বিতীয় বাঁক থেকে বাম দিকে কাঁকড়াঝোর যাওয়ার একটি সরু পাকা রাস্তা দেখতে পাবেন।ওই রাস্তা ধরবেন। ওই রাস্তা যে ভাবে গেছে ,সেই ভাবে কাশমার, রামপুর, জামির ডিহা, কাশি ডাঙ্গা, ছুরি মারা ইত্যাদি গ্রাম পার হয়ে ১০ কিমি গেলেই ময়ূর ঝর্ণা।
৩. কাঁকড়াঝোর:
ময়ূর ঝর্ণা থেকে কাঁকড়াঝোর মাত্র ৪ কিমি। ওই এক ই রাস্তা বরাবর এগিয়ে গেলে কাঁকড়াঝোর। এই রাস্তা কাঁকড়াঝোর হাটচালি তে গিয়ে বেলপাহাড়ী-কাঁকড়াঝোর-আমলাশোল-আমঝর্ণা রাস্তায় মিশবে। বামদিকের রাস্তা ধরলে ২২ কিমি এলে আবার বেলপাহাড়ী পৌঁছে যাবেন। তার আগে কাঁকড়াঝোরে নিচের স্পট গুলো পরপর ঘুরে একবার দেখে নিতে পারেন : ১. আমলা শোল-আমঝর্ণা ২. আমলাশোল -বক ডোবা পথে ৩ কিমি গিয়ে ফিরে আসা। ৩. বাবা ভৈরব থান।
৪. কেটকিঝর্ণা :
কাঁকড়াঝোর থেকে এবার বেলপাহাড়ী র রাস্তা ধরতে হবে। সাতবাকি, মাকুরভুলা, কদমডিহা, বুড়িঝোর, শুসনিজবি গ্রাম পার হলেই মোটা মুটি ১০ কিমি এলে সিঙ্গাডুবা গ্রাম। সিঙ্গাডুবা গ্রামের শুরুতেই বাম দিকে বড় বট গাছ, বাম দিকের মোরাম রাস্তা ধরে মোটা মুটি ১ কিমি গেলেই কেটকিঝর্ণা।
৫. ঢাঙ্গিকুসুম হুদহুদী : -
কেটকি ঝর্ণা দেখে একই পথে ফিরে বেলপাহাড়ী র পথ ধরতে হবে। এর পরে বাঁশপাহারি গ্রাম পার হয়ে ২ কিমি এলে চিড়াকুটি হাটচালি, ডান দিকে নেমে গেছে পাকা রাস্তা।তিন মাথার মোড়ে রয়েছে একটি স্ট্যাচু। ডান দিকের রাস্তা দিয়ে ২০০-৩০০ মিটার যাওয়ার পর আবার ডান দিকে যে রাস্তা গেছে ওই রাস্তা বরাবর সাড়ে তিন কিমি গেলে ( কিতাজুড়ি,ডাহুক খোলা গ্রাম পার হলে) পাহাড় টপকে ঢা ঙ্গি কুসুম গ্রাম। স্থানীয় মানুষের সহায়তায় হুদহুদী জলপ্রপাত।
***লাঞ্চ টাইম:( আনুমানিক দুপুর ১ থেকে ২ টোর মধ্যে)
হুদহুদী দেখে আবার আপনাকে কাঁকড়া ঝোর-বেলপাহাড়ী এর রাস্তা ধরে ( ওই তিন মাথা থেকে ডান দিকে) ধোবাকাচা, অদলচুয়া, খট্টাধরা crpf ক্যাম্প, ক্ষুদিমহুলি, বালিচুয়া, কুসুমডাঙ্গা, নটাচুয়া, বোদাডিহি, কোদপুরা, জরকডাঙ্গা, হয়ে ১০ কিমি এলে ৫ নং রাজ্য সড়ক ও বেলপাহাড়ী।ডানদিকে ২/৩ শ মিটার এলে আবার ইন্দিরা চক। এখানেই রয়েছে কাঁচালঙ্কা রেস্টুরেন্ট, হোটেল অভিনন্দন, খেয়াতরী হিন্দু হোটেল, হালদার হোটেল, বিডিও অফিস গেটে তৃপ্তি হোটেল ইত্যাদি।
৬.গাররাসিনি পাহাড় :
লাঞ্চ এর পর যে রাস্তা ধরে প্রথমে লালজল যেতে হয়েছিলো ,সেই রাস্তা ধরেই আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে মোটা মুটি ১ কিমি। (এবার ইন্দিরা চক ছাড়িয়ে 200 মিটার মত যাওয়ার পর মুল রাস্তা বাম দিকে বেঁকে গেছে, আর সোজা একটি পাকা রাস্তা চলে গেছে, বাম দিকে ঘুরেই ডান দিকে একটি কালি মন্দির, মার্ক করে রাখুন) ১ কিমি গেলে বাম দিকে একটি বড় জলের ট্যাঙ্ক, ওই জলের ট্যাঙ্ক পার হওয়ার পর বাম দিকে যে পাকা রাস্তা বের হয়েছে সেই রাস্তা ধরতে হবে। বাঁশকেটা, টুরু পাহাড়ি , গোহালবেড়া ,আগুইবিল গ্রাম (আগুইবিল প্রাইমারি স্কুল বাম দিকে রেখে ২/৩শ মিটার পর, )পার হয়ে মোটামুটি ৭ কিমি যাওয়ার পর ডান দিকে মোরাম রাস্তা(রাস্তার শুরুতেই একটি ছোট খড়ের ঘর,উল্টো দিকে জাম গাছ) ধরে ২ কিমি গেলে গাড়রাসিনী পাহাড়।
৭. খান্দারানী জলাধার:
গাররাসিনি পাহাড় দেখে ফিরে আসার সময় গোহালবেড়া গ্রাম এর মোবাইল টাওয়ার থেকে বাম দিকের (দরকারে স্থানীয় মানুষের সহায়তা নেবেন) রাস্তা দিয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকলে ২০০ মিটার গেলেই গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, ওখান থেকে ডান দিকে যে রাস্তা বের হয়েছে,সেই রাস্তা ধরে ৪ কিমি গেলে বারিঘাঁটি গ্রাম পড়বে। ওই গ্রামে ঢুকেই বাম দিকের রাস্তা ধরে খান্দারানী জলাধার।
৮. তারাফেনী ড্যাম:
খান্দারানী জলাধার দেখে আপনাকে বেলপাহাড়ী আগে উল্লিখিত কালীমন্দির চক থেকে বাম দিকের (ফেরার সময় বাম দিকেই পরবে) পাকা রাস্তা ধরে ৭ কিমি গেলে তারাফেনী ড্যাম। এই রাস্তায় ৩ কিমি মত আসার পর বাম দিকে একটি পাকা রাস্তা বের হয়েছে মার্ক করে রাখবেন)
৯. ঘাগরা জলপ্রপাত: তারাফেনী ড্যাম দেখে ফেরার সময় ৪ কিমি এসে যাওয়ার সময় যে পাকা রাস্তা মার্ক করেছিলেন,সেই রাস্তা ধরে ২ কিমি গেলেই ঘাগরা জলপ্রপাত।
বিশেষ পরামর্শ :
১.বেলপাহাড়ীতে এসে আগে থেকে লাঞ্চ এর অর্ডার দিয়ে রাখবেন। কেননা বেলপাহাড়ী পার হয়ে গেলে তেমন আর লাঞ্চ করার জায়গা পাবেন না। অর্ডার করে না গেলে লাঞ্চ এর খাবার নাও পেতে পারেন।
২. সঙ্গে প্রয়োজনীয় জল ,স্নাক্স ইত্যাদি রাখবেন।
৩. নিজের গাড়ি নিয়ে এলে গাড়িতে পর্যাপ্ত ডিজেল/পেট্রোল ভরে নিয়ে আসবেন।বেলপাহাড়ীর ১০ কিমি আগে সিলদা পার হয়ে কানি মহুলি বা ওরগোন্দা ছাড়া আর কোন পেট্রোল পাম্প নেই।
৪. কোন পর্যটন স্থলে আপনার সঙ্গে বহন করা জলের বোতল, চিপসের প্যাকেট ,বা প্লাস্টিক কোন বর্জ্য ফেলবেন না। স্থানীয় প্রশাসন এর নজরে পড়লে আপনার সমস্যা হতে পারে।
৫. কোনরকম বন্য জন্তুকে বিরক্ত করবেন না। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল হাতির চলাচলের জায়গা। সাবধানে থাকবেন।
৬. কোন পর্যটন স্থানেই কোন রকম নেশা দ্রব্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন।
৭. এখানে কোথাও সে রকম অত্যাধুনিক শৌচালয় নেই। শৌচ কর্ম নিজের দায়িত্বে করতে হবে। বেলপাহাড়ী ইন্দিরা চক, ও বেলপাহাড়ী থানার পাশে একটি করে সুলভ শৌচালয় আছে ।
৮.স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কোন জঙ্গলে একাকী প্রবেশ , টেন্ট খাটিয়ে রাত্রি বাস করা , কিংবা আগুন জ্বালিয়ে জঙ্গলে পিকনিক করতে যাবেন না। সমস্যা হতে পারে।
৯. পথে কোথাও আপনার পরবর্তী ভ্রমণ স্থানে পৌঁছতে বা পথ চিনতে অসুবিধা হলে স্থানীয় মানুষের সহায়তা পাবেন।
১০. বেলপাহাড়ী ভ্রমণ শেষে কোন স্মারক নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলে ঢা ঙ্গি কুসুম গ্রামে ওই গ্রামেই প্রস্তুত পাথরের থালা,বাটি, গ্লাস,প্লেট, মূর্তি ইত্যাদি পাবেন।
১১. এলাকার বহু স্থানে কোনরকম মোবাইল নেট ওয়ার্ক নাও পেতে পারেন। বেলপাহাড়ী পার হয়ে গেলে জিও এর মোবাইল নেটওয়ার্ক ছাড়া অন্য কোন মোবাইল সংযোগ নাও পেতে পারেন। আর গুগল ম্যাপ এর উপর ভরসা করে সব জায়গা তে যাওয়ার চেষ্টা করলে সমস্যায় পড়তে পারেন।
১২. প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, উপরের বহুল পরিচিত জায়গাগুলো ছাড়াও রয়েছে:-
ক) মাকুরভুলা-চাতরা জলপ্রপাত (বেলপাহাড়ী র দীর্ঘতম জলপ্রপাত)
খ) পবন পাহাড় (চিতি পাহাড়//বালি চুয়া)
গ) হাঁসা ডুঙরি (শ্বেত পাথরের পাহাড়/কেন্দা পাড়া)
ঘ) গজপাথর/তুলসিবনী সরোবর
ঙ) কানাইসর পাহাড়
চ) গজ ডুঙরি
ছ) চাতন ডু ঙ রি আদিম মানুষের গুহা ও সানসেট ভিউ পয়েন্ট
জ) গাঢ়পাহাড় এর লাট্টু পাহাড় ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পয়েন্ট
ঝ) বিচিত্রপাহাড় বা খুন ডু ঙ রি ( কাঁটটারা গ্রামে)
ঞ ) কাঁকরি ঝর্ণা -ডাকাই ভ্যালি।
ট) লকাইসিনি পাহাড় ভিউ পয়েন্ট
ইত্যাদি
Comments