বেলপাহাড়ী ভ্রমন এবং বাঁদনা পরব, গরু খুঁটান...// বিচিত্র গুপ্ত
বেলপাহাড়ী ভ্রমন এবং বাঁদনা পরব, গরু খুঁটান... // বিচিত্র গুপ্ত।
আছছা, যদি এমন হয়, প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করার জন্যে, অনেক প্লান পরিকল্পনা করে অবশেষে বেলপাহাড়ী আসা ঠিক করলেন এবং চলেও এলেন। বেলপাহাড়ীর পরিচিত গাড়রাসিনী,লালজল, ঘাগরা ,কেটকি ঝর্ণা,ময়ূরঝর্ণা,আমঝর্ণা ,কাঁকড়াঝোর, ঢাঙ্গিকুসুম ইত্যাদি দেখলেন এবং চলেও গেলেন।বেশ ভালো পরিকল্পনা।
কিন্তু ধরুন, এই প্রকৃতি পর্যটন এর সাথে , মানে একই সাথে এই বিস্তীর্ন অঞ্চলের জনজীবনের সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকা এক অন্যতম এবং সুপ্রাচীন উৎসব বা পরব উপভোগ করারও সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলেন, কি করবেন??? সেই সুযোগ হেলায় নষ্ট করবেন?? নিশ্চয় না!
আর মাত্র কয়েকদিন পরেই কালীপূজা।টানা তিন চার দিন ছুটিও রয়েছে। কোথাও দু তিন দিনের জন্যে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে বা পরিকল্পনা থাকলে , অরণ্য সুন্দরী ঝাড়গ্রাম জেলার বেলপাহাড়ীতে আসার সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন।কেননা ,বাঁদনা পরব ঠিক এই সময়ই হয়ে থাকে। কালীপুজোর দিন থেকে তিন দিন, মানে ভাই ফোঁটার দিন পর্যন্ত।
যারা ভাবছেন ,বাঁদনা পরব আবার কী?? তাদের জন্যে এই অঞ্চলের বিশিষ্ট এক প্রবন্ধকার শ্রী বিপ্লব মাহাত মহাশয় এর 'বাঁদনা পরব' নিয়ে লেখার একটি অংশ তুলে দেওয়া হলো:-
"
জঙ্গলমহলের মাহাত কুড়মী তথা সমগ্র আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম উৎসব হল এই বাঁদনা পরব।কার্ত্তিক মাস পড়লেই শুরু বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক রং করে বা মাটিলেপে লাতা দিয়ে ঘর পরিষ্কারের পালা।ঘাওয়া থেকে বুড়হি বাঁদনা পর্যন্ত এই পরব বেশকয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত।
কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যার আগের দিন ঘাওয়া ঐদিন লাতা মাটি দেওয়া বন্ধ,পরেরদিন অমাবস্যার দুপুরে প্রত্যেক গবাদি পশুকে স্নান করিয়ে সিঙে কচড়া তেল(মহুয়ার বীজ থেকে তৈরী)দিয়ে তাদের যত্নসহকারে খাওয়ানো হয়।তারপর গ্রামের সব গবাদিপশুকে একত্রিত করে চারণভূমিতে নির্দিষ্ট রীতি মেনে গঠপূজো করা হয় ও খঁড় ডেঙহানো হয়।এতে যে গরু ডিম ভাঙে তাকে বরণ করা হয়।বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে কাসীজিওরী,চালগুড়িতে গুড় ঘি মধু কার্পাস তুলোর বাতিতে শালপাতায় মলতা ঘাঁসের সাথে সন্ধ্যা দ্বীপ দেওয়া হয়।রাত্রে আবার গবাদিপশুর সিঙে কচড়া তেল দিয়ে, খাবার দেওয়ার পর গোয়ালঘরে জাগরণের ঘৃতপ্রদীপ স্থাপন করা হয়।
অন্যদিকে গরু জাগাতে হাজির ঝাঁঙগইড়া বা ধাঁঙগইড়ার দল।তাদেরকে গৃহস্থের তৈরী পীঠেপুলিতে আপ্যায়ন করা হয়।ঐহিরা গীতের মাধ্যমে চলে সারারাত্রি গরু জাগরণ।পরেরদিন কৃষি যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে তুলসী মঞ্চের সামনে রাখা হয়
আর বাড়ির গৃহিণীরা স্নান সেরে ঢেঁকিতে চালগুঁড়ি তৈরী করেন গরইয়ার পিঠা, গোয়ালপূজা,চোকপুরার(গরুর গোয়ালঘরের প্রবেশ পথে নির্দিষ্ট আল্পনা) জন্য।দুপুরে গোয়ালঘরে নির্দিষ্ট রীতি মেনে হয় গোয়ালপূজা।বিকেলে চোকপুরার পর তাতে সিন্দুরের ফোঁটায় রাঙিয়ে দেওয়া হয় গবাদিপশুর গোয়ালঘরে প্রবেশের পথ।রাত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম রীতি মেনে হয় গরু চুমানো(বরণ)।বাড়ির গৃহিনী নববস্ত্র পরিধান করে গবাদিপশুর পা ধুইয়ে মোড়(ধানগাছের তৈরী অলংকার)সিন্দুর পরিয়ে নতুন কুলোয় ধান দূর্বা ধূপ দ্বীপ সহযোগে এই নেগাচার পালন করেন।পরেরদিন দুপুরের আবার একই ভাবে সব গবাদিপশুকে বরণকরা হয়।বিকেলে শুরু গরু খুঁটানো।ঐহিরা গীত পরিবেশনের মাধ্যমে ঢোল মাদল ধামসা সহ বাদ্যযন্ত্র দ্বারা শুকনো চামড়া দ্বারা গরুকে খুঁটানো হয়। পরেরদিন বুড়হি বাঁদনা।আগের দিনের মতো একই ভাবে ঐহিরা গীত পরিবেশনে গরু মোষ খুটানোই মেতে উঠবে পুরো মাহাত কুড়মী সম্প্রদায় তথা পশ্চিম মেদিনীপুর,ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার সমস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন।শেষ দিন কাঁটা কাড়হা অর্থাৎ ঐ দিন যাঁরা গরু, মোষ চরান তাঁদের বিশ্রাম। আমার মতে "আমাদের বংশানুক্রমে এই উৎসব পালন করে আসছি,এটি যেমন একটি মিথ,তেমনই এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে।সবার বিশ্বাস এই কয়দিন বুড়হাবাবা শিব মর্তে আসেন গবাদিপশুর পরিদর্শনে।তাই তাঁকে তুষ্ট করতে ও কৃষি কার্যে সহায়তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনার্থে এইসব করা হয়।আর অলসতা ও আড়ষ্টতা কাটাতে তথা হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে দলকে রক্ষা করতে গরু খুঁটানো এক উৎসবের রূপনিয়েছে।"
এবার নিশ্চয় বাঁদনা পরব সম্পর্কে আপনার কিছুটা ধারণা হয়েছে এবং সেই পরব এবার বেলপাহাড়ী র কোথায় দেখবেন ,কিভাবে দেখবেন বা উপভোগ করবেন ,সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া হলো।
এই অঞ্চলের যে সব গ্রামে এই পরব ও গরু খুঁটান উৎসব ধুমধামের সাথে হয়ে থাকে,সেই সব গ্রামের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য --
১.বামুনডিহা গ্রাম।
২.বৈষ্ণবপুর গ্রাম।
৩. ঢাঙ্গিকুসুম গ্রাম।
৪. কাঁকড়াঝোর-আমলাশোল গ্রাম।
বেলপাহাড়ী থেকে তারাফেনী ড্যাম যাওয়ার পথে ,মোটামুটি ৪ কিমি গেলেই পড়বে বৈষ্ণবপুর গ্রাম। তারা আগে ডান দিকের পাকা রাস্তা বরাবার গেলে পড়বে বামুনডিহা গ্রাম। আর কাঁকড়াঝোর,আমলাশোল বা ঢাঙ্গিকুসুম গ্রাম গুগল ম্যাপ থেকেই পেয়ে যাবেন।
কালীপুজোর দিন ,সারা দিন আপনি বেলপাহাড়ীর বিভিন্ন প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্র গুলো ভ্ৰমন করলেন।সন্ধ্যায় ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিন।তারপর ডিনার শেষ করার পর , রাত ১০ টার পর বামুনডিহা গ্রামে চলে গেলেন কিংবা বৈষ্ণবপুর গ্রামে( যারা প্রপার বেলপাহাড়ীর কোন হোম স্টে তে থাকবেন ,তাদের জন্যে। ঢাঙ্গিকুসুম কিংবা কাঁকড়া ঝোর এর কোন হোম স্টে তে থাকলে সেখান কার গ্রামে চলে যাবেন)। দেখবেন কি ভাবে 'অহিরা গীত' গাইতে গাইতে দল বেঁধে মানুষ আনন্দ করতে করতে এ বাড়ি সে বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে। সারা গ্রামের মানুষ সারা রাত এই আনন্দ যজ্ঞে মেতে ওঠে। আপনি উপভোগ করবেন তাদের সাথে।
ভাইফোঁটার দিন ,বিকেল বেলা ওই গ্রাম গুলোতে হয় 'গরু খুটান' ।মানে আগামী ৬ ই নভেম্বর হবে গরু খুটান। সেই সঙ্গে কোথাও হবে মোরগ লড়াই। নিশ্চয় আগে মোরগ লড়াই দেখেন নি??এবার নিশ্চয় সেই সৌভাগ্য হবে।
তবে আর ভাবনা কিসের??এই কালীপুজোর কয়েকটা দিন না হয় এবার বেলপাহাড়ীতেই কাটুক। আর 'সমুদ্র মন্থন 'এর থিমে বেলপাহাড়ী র কাছেই 'নটাচুয়া গ্রামে' একটি ছোট্ট টিলা বা ডু ঙ রি র উপর স্থানীয় কালীপূজা,আপনাকে মুগ্ধ করবে, এ আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।
এখানে এসে কোথায় থাকবেন , কি ভাবে ঘুরবেন ইত্যাদি আপনি "youtube" সার্চ কবলেই পেয়ে যাবেন। তবুও কোথায় থাকবেন এখানে এলে ,তারএকটি লিঙ্ক এখানে উল্লেখ করে দেওয়া হলো।
https://www.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/4662631910455646/
সঙ্গের প্রথম ছবি টি বেলপাহাড়ীর বামুনডিহা গ্রামে ২০২০ সালের ১৪ ই নভেম্বর ,কালীপুজোর দিন তোলা।
Comments