ঝটিকা সফরে ঝাড়্গ্রাম-বেলপাহাড়ী-কাঁকড়াঝোর - পর্ব ৫// সুমেধা চট্টোপাধ্যায়

ঝটিকা সফরে ঝাড়্গ্রাম-বেলপাহাড়ী-কাঁকড়াঝোর

পর্ব ৫
বেলপাহাড়ী, কাঁচালঙ্কা ও বিধানদা'র গল্প...

বিধানদা (এনার বিষয়ে সবিস্তার আছে নীচে) আমাদের ঝাড়্গ্রাম-বেলপাহাড়ী-ঝাড়্গ্রাম গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এর মূল কারণ হল আমাদের দুই পরিবারের গাড়ীই ছোট...অল্টো। বেলপাহাড়ীর বেশ কিছু রাস্তায় এই গাড়ীতে যাওয়া বেশ চাপের। তাই হয় বেলপাহাড়ীতে গাড়ি রেখে যেতে হবে বা ঝাড়্গ্রাম থেকেই গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। সকালে ব্রেড-অমলেট-চা ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেলপাহাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একটি এসি স্করপিও গাড়ি আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। ড্রাইভার দাদার নাম রবি কিস্কু। বিধান'দা র টুর ডে ট্রীপের প্ল্যান অনুযায়ী আমরা প্রথমে লালজল, ময়ুরঝর্ণা, কেটকি, ঢাঙ্গি কুসুম হুদহুদী দেখে লাঞ্চ করব কাঁচা লঙ্কাতে তারপর গাড়রাসিনী পাহাড়, ঘাগরা জলপ্রপাত, খাঁদারানি লেক ও তারাফেনি ড্যাম দেখে ঝাড়্গ্রাম ফিরে আসব। 

সেইমতো বেলপাহাড়ীর দিকে রওনা দিলাম। চোখজুড়ানো সবুজের মাঝে পিচ রাস্তার গালিচা। শুধু তাকিয়ে থাকতে হয়৷ আমরা পালা করে সামনে বসে কিছু ভিডিও ও ছবি তুলে রাখলাম। প্রথম গন্তব্য ঢাঙ্গিকুসুম গ্রামের হুদহুদী জলপ্রপাত।  ঢাঙ্গি শব্দটিও স্ত্রী লিঙ্গ। আসল শব্দ ঢাঙ্গা। মানে লম্বা। স্ত্রী লিঙ্গে ঢাঙ্গি। 
আর , যেখানে ওই জলপ্রপাতটি রয়েছে, তার নির্দিষ্ট নাম ছিল না। গ্রামে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে বলতো , ' ও, জঙ্গলে যেখানে হদ হদিয়ে জল পড়ছে,সেই জায়গা?'
হদ হদিয়ে জল পড়া মানে উঁচু কোন স্থান থেকে সশব্দে জল পড়া কে বোঝায়। এই যে 'হদ হদ ' করে জল বয়ে যাওয়া কে নাম দেওয়া হলো ,হদ হদি /হুদ হুদি ।জলপ্রপাত। আর একটি জনশ্রুতি, কাদা যুক্ত মাটিকে এখানকার ভাষায় হদহদি বলে। সেখান থেকেও 'হুদহুদি' নামের উৎপত্তি বলে মনে করেন অনেকে।

গাড়ি যেখানে নামালো সেখান থেকে বেশ খানিকটা রাস্তা হেঁটে পাথুরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। শাল-মহুয়ার বেশ ঘন বনপথ। কিছুটা পাহাড়ি রাস্তায় হাইকিং এর মতো। অনেকক্ষণ ধরেই ঝর্ণার আওয়াজ পাচ্ছিলাম কিন্তু তিনি দেখা দিচ্ছিলেন না। প্রায় মিনিট ১৫-২০ র বন্ধুর কিন্তু নয়নাভিরাম যাত্রাশেষে দেখা দিলেন হুদহুদী৷ খরস্রোতা, বেগবতী.....সৌমিত্র নীচে নেমে বেশ কিছু ছবি তুললো। আমরা ঝর্ণার একদম ওপরে দাঁড়ালাম। ঘোর লেগে যায় নীচে তাকালে। বেশ কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। প্রসঙ্গত বলে রাখি, স্নান করার ইচ্ছা থাকলে বা জলে নামতে চাইলে প্লাস্টিকের জুতো পরতে পারেন, কিন্তু এতটাই পাথুরে রাস্তা এবং বেশ চড়াই-উতরাই আছে। আমার স্নিকার থাকায় খুব সুবিধা হল। ঢাঙ্গি-কুসুম গ্রামের আদিবাসীদের হাতে তৈরি কিছু পাথরের জিনিস পাওয়া যায়। স্মারক হিসেবে সংগ্রহযোগ্য।  ফিরে এলাম সদলবলে গাড়ির কাছে।।। 
এবার ময়ূরঝর্ণা হয়ে কেটকি। মূল রাস্তা থেকে কাঁচা রাস্তায় ঢুকে পড়া। এবং শেষে অসম্ভব সুন্দর শান্ত একটি লেক বা জলাধারও বল যায়৷ বেশ কিছু ক্ষীণ জলধারা নানা দিন থেকে নেমে এসে একজায়গায় খানিক জল ধরে রেখেছে৷ কোন মানুষজন চোখে পড়ল না। আমরা অনাঘ্রাত প্রকৃতিতে লীন হলাম। কালো মেঘে ঈষান কোণে মন্দ্র শুনতে পেলাম। পরের গন্তব্য কাঁকড়াঝোর। 

কাঁকড়াঝোরে আমরা কোথাও নামিনি। রবিদা আমাদের বেশ কিছু আর্মি ক্যাম্প বা ফরেস্ট অফিসারের বাংলো দেখালেন। তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। আমলাশোল-আমঝর্ণার পথে আমরা খানিক দূর গেলাম। কালো হয়ে এসেছে চারিদিক। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সর্পিল রাস্তা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দিল। তেমন কোন গাড়ি বা মানুষজন চোখে পড়ল না। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে এই শ্বাসরোধকারী জার্নি অবিস্মরণীয় হয়ে রইল। বাবার প্রথম পোস্টিং ছিল ঝাড়্গ্রাম রাজ কলেজ। সেটা সত্তরের দশক। সেই  সময়ে এবং আশির দশকেও শুনেছি এই জায়গা একদমই নিরাপদ ছিল না। মাও-অধ্যুষিত বলে। এখন অবশ্য সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে একটি ফরেস্ট অফিসার বাংলো রবিদা দেখালেন যেটি বহন করে চলেছে মাও-আতঙ্কের 'জ্বলন্ত' দগদগে ঘা....পোড়া দাগ।
মায়াবী বৃষ্টিস্নাত ভয়ঙ্কর এক ছায়াপথ পেরিয়ে পরের গন্তব্যে এলাম। 
লালজল।  পাহাড়ের মাঝে ছবির মতো গ্রাম লালজল। এখানকার দেওপাহাড়ে (লালজল পাহাড়ও বলা হয়)। পাহাড়চুড়ায় একটি গুহা আছে৷ বেশ খাড়াই উঠে যেতে হয়। এখানকার ঝরনার জল সামান্য লালচে। তামা ও লোহা মিশ্রিত জল বেশ সুস্বাদু। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, লাল রঙের এই জলের কারণেই গ্রামটির নাম লালজল।  

দেওপাহাড়ে আদিম মানবের গুহাটি দেখতে হলে পাহাড়ের খাঁজ ধরে সতর্ক ভাবে উঠতে হয়। সৌমিত্র খানিক দূর উঠেছিল। খুব খাড়া রাস্তা।  আমরা কেউ চেষ্টাই করিনি। স্থানীয় একজন ব্যক্তি জানালেন, গুহার ভিতরের দেওয়ালে খোদাই করা আছে নানা ধরনের ছবি। একটি ছবিতে একাধিক রঙের ব্যবহার রয়েছে। যদিও সেগুলি গুহার ভিতরে না ঢুকলে দেখা সম্ভব নয়। ঝাড়গ্রামের লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতে, এক সময় এই গুহার বিভিন্ন স্তর থেকে আদিপ্রস্তর, মধ্যপ্রস্তর নব্যপ্রস্তর, তাম্রপ্রস্তর ও লৌহপ্রস্তর যুগের নিদর্শন মিলেছিল। 
ষাটের দশকে লালজলের গুহায় একটি চিতাবাঘও ছিল। জনশ্রুতি, ওই বাঘের সঙ্গেই গুহায় থাকতেন রামস্বরূপ নামে এক সন্ন্যাসী। ১৯৮৩ সালে রামস্বরূপের উদ্যোগে লালজলে বাসন্তী পুজোর প্রচলন হয়। ১৯৯৫ সালে রামস্বরূপের মৃত্যুর পরে তাঁকে দেওপাহাড়ের কোলে সমাধিস্থ করা হয়। এখনও বাসন্তী পুজোর চল রয়েছে। সে সময়ে পাঁচ দিনের মেলা বসে লালজলে। (তথ্যসূত্র অন্তর্জাল এবং বিধান দা)। 
লাঞ্চ টাইম। এবার গন্তব্য 'কাঁচা লঙ্কা'। 
এবার আসি আমার ঝাড়্গ্রাম ভ্রমণের এক বিশাল প্রাপ্তি বিবরণে। বিধান দেবনাথ।  এনার কথা জানতে পারি আমার আর এক খুব প্রিয় ভ্রামণিক দাদা এবং ভ্রমণ-লেখক গৌতমদার কাছ থেকে। বলেছিলেন 'যে কোন সমস্যায় বিধানদা'কে জানাবে।' ঝাড়্গ্রাম যাওয়ার আগে টুকটাক কথাবার্তা হয়। দাদা জানিয়েছিলেন ঝাড়্গ্রামে ঋতুরাজ বর্ষা,  বসন্ত নয়। গাড়ি এবগ বেলপাহাড়ি যাওয়ার বিষয়ে অনেকবার বিরক্ত করেছি। হাসিমুখে প্রত্যেকবার কথা বলেছেন। চাকুরিজীবী মানুষ ছিলেন। ৪০ বছর বয়সের পর চাকরি না করে নিজে কিছু করার তাগিদে বেলপাহাড়িতে 'কাঁচা লঙ্কা' স্থাপন। তিন বছরের কিছু বেশিতেই পরিচিতি ঈর্ষনীয়। আরও জানতে পারি ওনার সাহিত্য-প্রীতির কথা।বেলপাহাড়ি থেকে 'ডুংরি' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।  আদতে 'কাঁচা-লংকা' একটি ভাতের হোটেল। কিন্তু এত যত্নের সাথে নিজের মন্দিরটি এখানে লালন করেন বিধান'দা তা বলার নয়। আমাদের খাবার আগে থেকে বলা ছিল। কিন্তু মেনু দাদা নিজেই ঠিক করবেন বলেছিলেন। ভাত ডাল শাক আলুভাজা ভোলা মাছ দেশি মুরগির ঝোল চাটনি..... শেষে নিজেকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বসতে হচ্ছিল। মাঝে বারকয়েক এসে সহাস্যে বললেন 'যা লাগবে চেয়ে নেবেন কিন্তু'। প্রচন্ড ব্যস্ততাতেও এসে আমাদের অনুরোধে সেলফিতে সঙ্গ দিলেন। অবাক হয়ে দেখলাম এখানে প্রি-অর্ডার করা না থাকলে খাবার পাওয়া যায় না। এটি আমাকে মুগ্ধ করল কারণ খাবারের মানের সাথে আপোস করে যতজন ইচ্ছা খাওয়ালাম এই চিন্তাধারার পক্ষপাতী আমি নই, এরই প্রতিফলন দেখলাম 'কাঁচা লঙ্কা'তেও। চব্য-চষ্য খেয়ে আবার বেরোনো। তবে এইটুকু সময়ের মধ্যেই দেখলাম ওনার ভালো ব্যবহারের জন্য আশেপাশের বহু মানুষ অত্যন্ত সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। অতীব অমায়িক ব্যবহার এবং মানুষকে সাহায্য করার ইচ্ছা এই বিধান দেবনাথ মহাশয়ের ইউএসপি। ঐ টুকু সময়েও আমাকে বলতে ভোলেন নি 'আপনার লেখাগুলি কিন্তু খুব সুন্দর,' আবার টিনটিনের সাথে নিজের ছোট্ট কন্যার পরিচয়কালে বললেন 'টিনটিন-দাদা কিন্তু দারুণ কবিতা বলে।আর ইনি গবেষণা করেন জানিস।' শিক্ষার ছাপ স্পষ্ট। শত ব্যস্ততা এবং কর্মযজ্ঞের মাঝেও যেভাবে সময় দিলেন এবং সাহায্য করলেন মনে থাকবে আজীবন। 
বিধানদা'র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবার আমরা এলাম গাড়রাসিনি পাহাড়ে। চড়াই পাহাড় প্রায় ২০ মিনিটের রাস্তা। ওপর থেকে চারপাশের অনবদ্য ভিউ এবং দূরে খাঁদারানি লেক...... তাকিয়ে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। কাঁচা লঙ্কা থেকে পেট ভর্তি করে খেয়ে এই পাহাড় চড়তে গিয়ে আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়েছিল। তবে ক্ষুদে দু'জনের কোন হেলদোল ছিল না। ওরা তরতরিয়ে উঠল। হাঁসফাস করতে করতে যখন পাহাড় থেকে নামলাম তখন আলো কমতে শুরু করছে। খাঁদারানি বাদ পড়লেন। ঘাগরা আর তারাফেনি ড্যাম দেখে ফিরে যাব ঠিক হল। ঘাগরা'র সামনে গিয়ে এবার আমরা সবাই কথা হারালাম। তারাফেনি নদীর খর জলধারা সবেগে ধাবমানা। প্রচন্ড গতিশীলা। বর্ষায় ভয়াল রূপ। ড্রাইভার দাদা জানালেন এবারের মতো রূপ বহু বছর পর৷ ভালো লোকেরা ভাগ্যবান হয়৷ সিদ্ধার্থ তো একটি পাথরের উপর বসেই পড়ল আরাম করে ক্যামেরা নিয়ে। সত্যিই ঘাগরার সৌন্দর্যে বাক্যহারা হলাম। কথা দিয়ে এলাম তাকে একদিন পূর্ণিমার রাতে কথা হবেই। 
এরপর আমরা তারাফেনি নদীর ওপর একটি বাঁধ দেখতে এলাম। অল্প ক'টি লকগেট খোলা ছিল। নীচে চরায় কাশফুলের মেলা। অপরূপ দৃশ্য। দিনাবসানে চারিদিক অন্ধকার হচ্ছে। পাখিরা ফিরছে বাসায়৷ আমাদেরও এটি শেষ গন্তব্য ছিল। 
বেলপাহাড়ী খুব ভালো লাগল। তাই আমরা ঠিক করলাম এরপর এখানে এসেই দিন তিনেক থাকব। বর্ষায় বেলপাহাড়ীর মোহময়ী রূপ যারপরনাই আনন্দ দিল আমাদের। শীতকালে গাড়রাসিনি ছাড়া বাকি সব ক'টি জায়গাই খুবই ম্রিয়মান লাগবে। 
এবার মন খারাপের পালা। গাড়ি এগোতে শুরু করল। পিছনে পড়ে রইল বেলপাহাড়ীর নয়নাভিরাম প্রকৃতি,  কাঁকড়াঝোরের রহস্যময়তা এবং এক অত্যন্ত সজ্জন ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের আতিথেয়তা। বিদায় বেলপাহাড়ী। 
আগামী পর্বে....শেষ দিন ও খোয়াবগাঁ।

Comments

Popular posts from this blog

বেলপাহাড়ীর ঘোরার জায়গা গুলোর লিস্ট

গাড়ি ভাড়া /ঝাড়গ্রাম - বেলপাহাড়ী ট্যুর

বেলপাহাড়ীর হোম স্টে ও রিসোর্ট নাম্বার@ বিচিত্র গুপ্ত