বেল পাহাড়ী ভ্রমণ ডিসেম্বর ২০২১ /প্রথম পর্ব// সূর্য পাল
বেলপাহাড়ি ভ্রমণ ডিসেম্বর 2021
(প্রথম পর্ব )
বেলপাহাড়ি, নামটার মধ্যেই একটা মাধুর্য লুকিয়ে আছে । শুনেছি বেলপাহাড়ীতে ঋতুরাজ বসন্ত নয়, ঋতুরাজ বর্ষা । তবে আমরা ডিসেম্বরের শেষের দিকে, মিঠে রোদ গায়ে মাখতে মাখতে, বেলপাহাড়ীর গ্রামের পথ ধরে ধরে একটু ঘুরে এলাম, তিনদিনের অবকাশে ।
এক অনাবিল আনন্দের আকাশ মন প্রাণ সব ভরিয়ে দিল । খুব ইচ্ছে করছে সবার সঙ্গে সেই আনন্দটুকু ভাগ করে নিতে ।
আমরা ছিলাম ইন্দিরা চক, মানে বেলপাহাড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা যায় যে জায়গাটাকে তার খুব কাছেই 'বিজলী ভবন হোম-স্টে' ।
বেলপাহাড়ীর ইন্দিরা পয়েন্ট থেকে
এসবিআই রোড ধরে ঢুকতেই প্রথমে
ডান দিকে কাঁচালঙ্কা ফ্যামিলি রেস্টুরেন্ট, খেয়াতরী জলখাবার এবং খাবার হোটেল । তারপরে পার হয়ে বামদিকে এসবিআই,
একটি তেলেভাজার দোকান ।
এরপরে রাস্তা যেখানে ডান দিকে ঘুরে গিয়েছে, সেখানেই বাম দিকের কোনায় 'অতিথি নিবাস গেস্ট হাউস।'
এই রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা এগোলেই বাগানবাড়ি হোম-স্টে । ইন্দিরা পয়েন্টে টোটো স্ট্যান্ডের বামদিকে গলির মধ্যে দিয়ে পার হয়ে, খোলা জায়গায় বিজলী ভবন হোম-স্টে ।
এখন ইন্টারনেটের দৌলতে বেলপাহাড়ীতে কোথায় থাকা যায় এরকম কি রকম খরচ পড়ে তার প্রায় সবই আমাদের জানা তবুও
বেলপাহাড়ীতে আর যেখানে থাকা
যায় সেগুলো হলো : -
বেলপাহাড়ী গেস্ট হাউস :-
8972999926
লাল পিঁপড়ে ফ্যামিলি গেস্ট হাউস :-
7501644788
বাগান বাড়ি :-7547928202
রাজ হোম স্টে :-8972918589
তিতলি হোম স্টে :- 9647297283
অরণ্য গেস্ট হাউস : 9647275553
পবিত্রা হোম স্টে (আগুইবিল):-
6295231416
উমুল হোম স্টে(ঘাগরা):-9432960613
হুদহুদি হোম স্টে (ঢাঙ্গিকুসুম)
8768296140
আমরা পাঁচজন বড় আর একটি কোলের বাচ্চা সকলে মিলে সকালবেলা দমদম থেকে রওনা হয়েছিলাম । বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে, দূর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে, বাঁদিকে মুম্বাই রোড ধরে দু'দিকের বিস্তীর্ণ প্রান্তর দেখতে দেখতে, মন হয়ে যাওয়া চোখ নিয়ে পৌছালাম লোধাসুলি ।
গোয়েন পেট্রোল পাম্প পার হয়ে ডান দিকে ঘুরে যেতে হবে । আবার চলতে থাকা ।
আস্তে আস্তে রাস্তার দুই দিকের চরিত্র পাল্টাতে আরম্ভ করলো । বুঝলাম এবার আমরা জঙ্গলে প্রবেশ করছি । রাস্তার পাশের শাল,সেগুন, মহুয়া আর অন্যান্য গাছের ঘন জঙ্গল । মনে হচ্ছিল শালবনির ভেতর দিয়ে চলেছি ।
ঠিক, রাস্তার পাশে দেখলাম পোস্টে লেখা রয়েছে শালবনি ।
যেতে যেতে বাঁ দিকে একটি ডোবার মধ্যে দেখলাম প্রচুর পদ্ম ফুল ফুটে রয়েছে ।
যদিও আমি প্রথমে দেখতে পাইনি । দেখতে পেয়েছে আমাদের সহযাত্রী সুমনা ।
গাড়ি থামিয়ে কয়েকটা ছবি নেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না । খড়ের কাঠামো পড়ে থাকতে, বুঝলাম এখানে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়েছিল ।
এরপর কলাবনি পার হয়ে ওল্ড ঝারগ্রাম । ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি ।
বাঁদিকে পেট্রোল পাম্পের পাশে একটা রেস্টুরেন্টে দোতালায় কিছু খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম । বেশ ভালো খাবার । গরম গরম তন্দুরি রুটি, মাংস, পনির তরকারি, ভালো লেগেছিল ।
কাছেই রামকৃষ্ণ মিশন, দুপুরবেলা বন্ধ ছিল । তবুও সিকিউরিটিকে অনুরোধ করে দরজার ফাঁক দিয়ে ঠাকুর-মা- স্বামীজীকে মনে মনে প্রণাম জানালাম ।
এরপর বিদ্যাসাগর স্ট্যাচু পার হয়ে, আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে চলতে বাঁদিকে রেলস্টেশন রেখে এগিয়ে চললাম ।
এরপর কখনো গ্রাম, কখনো ঘন জঙ্গল, কখনো ধান কেটে নেওয়া বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে প্রায় এক ঘন্টা পনেরো মিনিট পরে আমরা পৌঁছালাম বেলপাহাড়ি ইন্দিরা পয়েন্ট ।
বিধান বাবুর সাথে দেখা করলাম এবং কী ভাবে আমাদের বেলপাহাড়ি ভ্রমণ সম্পূর্ণ করা যায় ওনার কাছ থেকে জেনে নিলাম ।
উনি আমাদের একটা হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালেন । যেটা সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ফলো করলেই বেলপাহাড়ীর চারদিকটা ঘুরে দেখে নেওয়া যায় । ওনার পরিচালিত 'কাঁচালঙ্কা' ফ্যামিলি হোটেল । রেস্টুরেন্ট ঢুকতেই ওয়েলকাম নোট হিসেবে এক কাপ করে গরম চা।
রাত্রের খাবার ওনারা আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন । খুব হালকা এবং স্বদিষ্ট খাবার ।
প্রায় দৈনন্দিন বাড়িতে রান্না করা খাবার এর মতই ।
বিজলী ভবন হোম-স্টের ছাদটি ভারী সুন্দর । পাশে একটি বিশাল জলাশয় । এবং প্রায় সম্পূর্ণ জলাশয়টি পদ্মফুলে পরিপূর্ণ । একটু দূরে জঙ্গল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, কিছু দূরে পাহাড়ের শ্রেণীও দেখা যাচ্ছে ।
হোটেলটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সর্বোপরি খুব অমায়িক ব্যবহার সম্পন্ন হোটেলের কর্ণধার শ্রী প্রণব দত্ত ।
ভেবেছিলাম ভোরবেলা উঠে বেরিয়ে পড়বো, কিন্তু সঙ্গে বাচ্চা নিয়ে সেটা হয়ে ওঠেনি ।
'খেয়াতরী' হোটেলে গরম গরম লুচি, তরকারি আর মিষ্টি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ধাঙ্গী কুসুম এবং হুদহুদি জলপ্রপাত দেখতে যাব বলে ।
১৫ কিলোমিটার রাস্তা, আধঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগে পৌঁছাতে । কিন্তু আমরা রাস্তায় নেমে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে গেছিলাম বলে ঘন্টা খানিক সময় লেগেছে ।
জলপ্রপাত দেখতে যাবার সরু গলিটা বাঁ দিকে রেখে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম ধাঙ্গি কুসুম গ্রামে । গ্রামে ঢুকতেই বাঁদিকে ধান ঝাড়াই এর কাজ চলছে । আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার রঞ্জিত সিং ।
ক্লাস ফাইভে পড়েন এবং সর্বক্ষণের জন্য আমাদের সঙ্গী হয়ে গেলেন ।
পথ-প্রদর্শক হয়ে নিয়ে যাবে ঝরনা দেখতে ।
দুজন অল্প বয়সী বিবাহিত মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন । আমার মেয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলল । উল্টোদিক থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন "ফটো তুললে কিন্তু পয়সা দিতে হবে" । তার বাড়ির উঠানে খড়ের গাদা এবং ধান ঝাড়াই এর কাজ চলছে ।
বললাম "হ্যাঁ গো দাদা দেবো । আপনাদের গ্রামে ঘুরতে এসেছি, আলাপ করতে এসেছি ।
কিছু বিনিময় তো থাকবেই ।
আমরা কলকাতা থেকে কিছু নতুন জামা-কাপড় আর কিছু ব্যবহৃত (পরিষ্কার করে কাচা এবং যথাযথভাবে সেনিটাইস্ড্ করা) বাচ্চাদের জামা কাপড় নিয়ে গিয়েছিলাম ।
কাছে ডেকে একটা নীল রংয়ের ফুলহাতা টি-শার্ট পরিয়ে দিলাম রঞ্জিত কে ।
তারপরে ওদের ছোট ছোট বাচ্চা এবং বড়দের কিছু দিতে পেরে আমরা ধন্য হলাম ।
ওনারা যে দয়া করে আমাদের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করেছেন, তার জন্য আমরা ওনাদের কাছে কৃতজ্ঞ ।
সঙ্গে কিছু ছবি দিলাম ওনাদের অনাবিল সহজ-সরল মুখগুলো সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য । নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য নয় ।
গ্রামের আশপাশে প্রচুর তুলসী গাছ । আমাদের আগ্রহ দেখে রঞ্জিত আর আরেকটি বাচ্চা ছেলে তিন-চারটে তুলসী গাছ সুন্দর করে মাটি দিয়ে মুড়ে আমাদের উপহার দিল ।
তারপরে আমরা চললাম হুদাহুদি ঝরনা দেখতে । পথটা ভারী সুন্দর, দুই দিকে ঘন জঙ্গল, মাঝে মাঝে একটু সমান জায়গায় গ্রামের লোকেরা পাথরের নানান রকম জিনিসপত্র নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছেন ।
স্মারক হিসেবে কয়েকটি সংগ্রহ করলাম সেখান থেকে ।
ধাঙ্গী কুসুম গ্রামে ঢুকতেই বাঁদিকে একজন পাথর কাটার কারিগর থাকেন ।
গ্রামেরই আরেকজন বেশ বয়স্ক ভদ্রলোক একটি বিশেষ ধরনের পানীয় অফার করেছিলেন, কিন্তু আমি ওই রসে বঞ্চিত তাই সে স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি ।
যাইহোক এবড়োখেবড়ো উঁচু-নিচু পাথরের রাস্তা দিয়ে আমরা ঝর্ণাধারায় পৌছালাম ।
মাঝে মাঝে কয়েকটি বাচ্চা ছেলে মেয়ে সুর করে করে করে বলছিল "বিস্কুট খাবো পুঁইসা দাও । বিস্কুট খাবো পুঁইসা দাও ।"
না দিয়ে থাকা যায়না, দিলাম । কিন্তু পরে শুনেছিলাম ওদের পয়সা না দিয়ে, বিস্কুট কিনে দেওয়াটাই ভালো ছিল ।
রঞ্জিত আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল । এবং অতটুকু বাচ্চা ছেলে বারবার আমাদের সাবধান করল আমরা কোন দিক দিয়ে যাব না । এবং কোথায় কোথায় পিছল পাথর আছে । প্রায় আমাদের হাতে ধরেই ঝরনা নিচ পর্যন্ত নামতে সাহায্য করেছিল । এখন ঝর্ণার জলে বিশেষ স্রোত নেই, কারণ শীতকাল । বর্ষাকালে এখান দিয়ে হুড়হুড় করে কাদা মাটি মিশ্রিত জল নেমে আসে । তাই হয়তো ঝর্নাটির নাম হুদহুদি ।
একটু এগিয়ে এসে একবার ধাঙ্গী কুসুমে 'হুদহুদি গেস্ট হাউসে' ঢুকলাম ।
ঘরগুলোর ব্যবস্থাপনা এবং খাবারের কি বন্দোবস্ত জেনে নেওয়ার জন্য ।
ঘরগুলো কুঁড়েঘরের স্টাইল । ভেতরে কোথাও তিনটে, কোথাও চারটে এবং একটি ঘরে ছটি বিছানার বন্দোবস্ত রয়েছে । প্রতিটি ঘরেই গীজারের ব্যবস্থা আছে । বাথরুমটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । সামনেই রয়েছে খাবার তৈরি করে নেওয়ার ব্যবস্থা বা অর্ডার দিলে রান্না করে দেবেন সে ব্যবস্থা । ছোট্ট একটি চৌবাচ্চায় পদ্ম ফুল ফুটে আছে । ঘরগুলোর ভাড়া বারোশো টাকা থেকে দুই হাজার পাঁচশো টাকা পর্যন্ত । তবে সামান্য কিছু নিগোসিয়েট করা যায় ।
এরপরে আমরা কাঁকড়াঝোড় হয়ে, ময়ূর ঝরনা দেখে ওখান থেকে চলে গিয়েছিলাম বাঁশপাহাড়ি । এখন এই পর্যন্ত, এর পরের পর্বে সেই গল্প করব ।
https://m.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/5131883223530510/?mibextid=2JQ9oc
Comments