কানাইসর পাহাড় পুজো//বিচিত্র গুপ্ত

কানাইসর পাহাড় পূজো
(শনিবার,১ লা জুলাই,২০২৩)

@ বিচিত্র গুপ্ত

আজ থেকে ১০২ বছর আগে ,১৩২৮ বঙ্গাব্দে শ্রী যোগেশ চন্দ্র বসু মহাশয় তার কলকাতা থেকে প্রকাশিত "মেদিনীপুরের ইতিহাস " গ্রন্থে অধুনা ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর দুই নম্বর সমষ্টি উন্নয়ন অঞ্চলের বেলপাহাড়ির সন্দাপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত অঞ্চলে প্রতি বছর আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবারে অনুষ্ঠিত ' কানাইসর পাহাড় পূজো ' সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন :-

"এই জেলার পশ্চিম সীমান্তে বীণপুর থানায় কানাইসর নামে একটি পাহাড় আছে। এতদ অঞ্চলের পাহাড় কয়টির মধ্যে ইহাই সৰ্ব্বোচ্চ । প্রতি বৎসর আষাঢ় মাসে এই পাহাড়ে দুইবার পূজা হয় । তদুপলক্ষে বাঁকুড়া, মানভূম, সিংহভূম প্রভৃতি জেলা হইতে লোক আসিয়া থাকে। গিরি-শৃঙ্গের দৃশ্য অতি মনোরম। সেখানে নানা প্রকার অদ্ভুত ও বিচিত্র পুষ্পোদ্যান দৃষ্ট হয় ৷ তথায় প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষও আছে। শিখর দেশ বিস্তৃত; তন্মধ্যে মাত্র ছয় বিঘা ভূমি উদ্ভিদ বর্জিত সমতল ক্ষেত্র। অবশিষ্ট প্রায় পঞ্চাশ ষাট বিঘা ভূমি নিবিড় জঙ্গলাকীর্ণ। একস্থানে একটি জীর্ণ প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয়। এইরূপ কিম্বদন্তী যে, বহুকাল পূর্বে ঐ স্থানেই পাহাড়ের পূজা হইত। কিন্তু বলিদানের পর তথায় যার কাহারও থাকিবার বা যাইবার অধিকার ছিল না। এক সময় পূজক বলির খড়গ টি আনিতে ভুলিয়া গিয়া পুনরার যখন উহা আনিবার জন্য উপরে গমন করেন, তখন দেখেন যে, দেবতা তথায় দুইটি ব্যাঘ্র লইয়া উপবিষ্ট আছেন। দেবতার প্রত্যাদেশ হয়, 'আর কখনও এইস্থানে আসিও না— এবার হইতে নীচে পূজা করিও। তদবধি মার উপরে পূজা হয় না বা সচরাচর কেহ উপরে উঠেও না। দেবতার আদেশে হউক বা না হউক, ব্যাস্ত্রের তয়েই যে পূজকগণ আর অত উচ্চে সেই গলাকীর্ণ স্থানের জীর্ণ মন্দিরে বসিয়া পূজা করিতে সাহসী হন নাই তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। পাহাড়চীর সাহুদেশে 'দে হরির স্থান' নামে একটি প্রশস্ত স্থান আছে, তথায় কতকগুলি বড় বড় প্রস্তর আছে । এক্ষণে পূজা প্রথমে সেইস্থানে হয়। তৎপরে পাহাড়ের পূর্ব্বদিক দিয়া উপরে উঠিবার যে পথ আছে, সেই পথে কিছু দুর উঠিলে যে স্থানে উপনীত হওয়া যায় উহাই পূজার দ্বিতীয় স্থান। স্থানটা অত্যন্ত ঢালু বলিয়া বেশ লোক একত্র তথায় থাকিতে পারে না। একদল নামিয়া আসিলে আবার একদল উপরে যাইতে পারে। পূজার স্থানে প্রায় শত হস্ত দীর্ঘ এবং প্রায় পঞ্চাশ হস্ত প্রস্থ ও তদনুরূপ উচ্চ একটি প্রকাশ বিস্তর আছে। উহার মধ্য দিয়া একটি গর্ভ আছে; পূজা শেষ হইলে যাত্রিগণ ঐ গর্ভের উপরে আমলকী ও পুষ্পাঞ্জলি দিয়া নিম্নে হাত পাতিয়া থাকে। পূজারী বলেন, উক্ত আমলকী ও পুষ্প যত শীঘ্র যাহার হস্তে পতিত হয় তাহার মনকামনা তত শীঘ্র পূর্ণ হইয়া থাকে। আর যাহার হস্তে একবারে পড়ে না— তাহার মনস্কামনাও সিদ্ধ হয় না ।পৰ্ব্বত-গাত্রে একটি কূপ আছে। উহার গভীরতা মাত্র দুই তিন হাত হইলেও উহার সঙ্গে একটি ঝরণার সংযোগ থাকায় মেলার সময় পাঁচ ছয় হাজার লোক জলপান করা সত্বেও উহার জল সমভাবেই বৰ্ত্তমান থাকে ; জলও পরিষ্কার।"
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ,এই বছর অর্থাৎ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ - এর ১৫ ই আষাঢ় শনিবার, ইংরেজি ২০২৩ সালের ১ লা জুলাই ,শনিবার পড়েছে এই কানাইসর পাহাড় পুজো। 'কানাই(কৃষ্ণ?) ইশ্বর ' লোক মুখে হয়ে গেছে ' কানাইসর/ কানাইশহর ' পাহাড় পুজো।এই পুজোর দ্বিতীয় দিনে পার্শ্ববর্তি ' বারহাঘাটে ' হয় আদিবাসী দের নিজস্ব পূজো। ' বরাহ(শুকর) ঘাট/ বরা ঘাট " থেকে লোক মুখে প্রচলিত হয়েছে 'বারহাঘাট '।


কানাই সর পাহাড় পুজোর দায়িত্ব বর্তমানে রয়েছে অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলার চাকুলিয়া ব্লকের কেন্দাডাংরির ঢেঁঙ্গাম গ্রামের সেবাইত শ্রী সহদেব নায়েক (স্বামীজি ),শ্রী রবীন্দ্র নায়েক , শ্রী গৌরাঙ্গ নায়েক এবং শ্রী দানব নায়েক মহাশয়রা। সহদেব বাবু জানিয়েছেন, বংশানুক্রমে তারাই এই পুজো করে আসছেন। স্থানীয় ভাষায় এদেরকে বলা হয় ' লায়া বা দেহরী "। কত পুরুষ আগে থেকে এই পুজোর দায়িত্ব তারা পেয়েছেন সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে না পারলেও , তিনি জানিয়েছেন তার বাবা,দাদু,দাদুর দাদুরও আগে থেকে তাদের বংশের মানুষ এই পুজোর সাথে যুক্ত । অনুমান করা যায় প্রায় ৩০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে এরা এই পুজোর সাথে যুক্ত।

এক সময় এই পাহাড় পুজোর দিন আগত ভক্ত গণের প্রিয় খাবার ছিল লুচি ,মাংস এবং কাঠাল। 



















Comments

Popular posts from this blog

বেলপাহাড়ীর ঘোরার জায়গা গুলোর লিস্ট

গাড়ি ভাড়া /ঝাড়গ্রাম - বেলপাহাড়ী ট্যুর

বেলপাহাড়ীর হোম স্টে ও রিসোর্ট নাম্বার@ বিচিত্র গুপ্ত