#বেলপাহাড়ীর_ইতিউতি # কৌশিক হালদার
#বেলপাহাড়ীর_ইতিউতি
# কৌশিক হালদার
*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*
পশ্চিমবঙ্গে পাহাড়-জঙ্গল-ঝর্ণা আর আদিবাসী জনজীবন এর কম্বিনেশন একসাথে কোথায় পাবো? ৬/৭ বছর আগে হলেও বাঙালী শুধুমাত্র ডুয়ার্সের কথাই বলতো! ঠিকই। এখন কিন্তু জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জায়গার নামও সমানভাবে উঠে আসে।২ টি জায়গার তুলনায় যাওয়া বৃথা,কারণ প্রকৃতি নিজের মত করে সৃষ্টি করেছে এক এক জায়গার ভূমিরূপ, বৃক্ষরাজি,লোকসংস্কৃতি। এই ভিন্নতা আমাদের গর্ব শুধু না,আমাদের মত ভ্রমন পিয়াসীদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। হাত বাড়ালেই এমন সব মনিমুক্ত হাতছানি দেয়। এই যেমন বেলপাহাড়ী।ঝাড়খন্ড ঘেঁষা এই ব্লকটিতে ১দিনের ঝটিকাসফর করতে পারেন ,আবার ২/৩ দিনও অনায়াসে ঘুরে কাটানো যায়। হাওড়া/সাত্রাগাছি থেকে ভোর ভোর ট্রেনে চাপলে ৯ঃ৩০ থেকে ১০ টার মধ্যে ঝাড়গ্রাম। সেখানে চটজলদি জলখাবার খেয়ে আগে থেকে বলে রাখা গাড়ীতে বেড়িয়ে পড়া বেলপাহাড়ীর উদ্দেশ্যে। আমরা আগেরদিন চিল্কিগড় ও ঝাড়গ্রাম শহর দেখেছিলাম।রাত্রিবাস ঝাড়গ্রামেই। পরদিন জলখাবার খেয়ে ১০ টা'র মধ্যেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম বেলপাহাড়ীর উদ্দেশ্যে।
◾যে পর্যায়ক্রমে আমরা বেলপাহাড়ী ঘুরলাম তার বৃত্তান্ত নিচে দিলাম।
🔹১🔹ঢাঙিকুসুমঃ এককালে পর্যটন মানচিত্রে জায়গাটার কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। মাওবাদীদের কোর এরিয়া ছিলো এটা।ঘন জঙ্গলবেষ্টিত ছোটো ছোট পাহাড়-টিলা দিয়ে ঘেরা জায়গাটা বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ঢাঙিকুসুম ঢোকার সময় দেখলাম ২ টি টিলার মাঝখান থেকে পাহাড় কেটে কংক্রিটের স্ল্যাব ফেলে রাস্তা করতে হয়েছে। খুব কাছেই ঝাড়খণ্ড সীমানা হওয়ায় আত্মগোপন করার দারুণ সুবিধাও ছিলো। শোনা যায় দিনের বেলাও পুলিশ বা সেনা জওয়ানরা এদিকে আসতো না। বিভিন্ন জায়গায় পোঁতা থাকতো ল্যান্ডমাইন। এমন একদা বিচ্ছিন্ন জায়গায় লুকিয়ে আছে জঙ্গলের মধ্যে এক ছোট্ট ঝর্ণা। ক্ষীণধারা,কিন্তু লাবন্যে ভরপুর।চারিদিকে গভীর জঙ্গল আর দূরে তরঙ্গায়িত পাহাড়সারি।গাড়ী থামার পরে ঢেউখেলানো আঁকাবাঁকা পথে ২০/২৫ মিনিট জঙ্গলের মধ্যে হাঁটা। স্থানীয় ৮/১০ বছরের সরল বালকেরা আছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। ওদের কথানুযায়ী এই পায়ে চলা পথটাও না কি ওদেরই তৈরী। এখনও প্রশাসনের তরফ থেকে কোনো রাস্তা তৈরি না হওয়ায় বুনো রূপটা প্রকট আছে। পুরোদস্তুর পর্যটনকেন্দ্র হয়ে গেলে জায়গাটার কি হাল হবে ঠাহর করার চেষ্টা করছিলাম ওখানে পড়ে থাকা চিপসের প্যাকেট আর ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা মদের ভাঙা বোতল বা বিয়ারের খালি ক্যান দেখে।আরও দেখে অবাক হলাম যে সক্কাল ১১ টার সময়ই ৪/৫ জন লোক দেশী হুইস্কির বোতল নিয়ে ঝর্ণার জল সহযোগে পান করছে।আবার ওই জলেই পা ডুবিয়ে তারা বসেও আছে! বাহ্ রে পর্যটক বাহ্!! যাইহোক বাচ্চাদের কথা আগে থেকেই জানতাম। তাই কিছু বিস্কুট আর লজেন্স নিয়ে গেছিলাম।যা পাওয়ার পরে ওদের বিস্ময়মিশ্রিত হর্ষের অভিব্যাক্তিও এই সফরের এক বড় পাওনা হয়ে থেকে যাবে।
ঢাঙিকুসুম কিন্তু নিদেনপক্ষে একটা বেলা প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকের কাছে দাবী করে।
🔹২🔹গাড়রাসিনী পাহাড়ঃঅনবদ্য জায়গা! আর একবেলা এইখানেই দিব্বি কেটে যাবে। নামটা একটু বিকট,কিন্তু বেশীবার উচ্চারণ না করলেই হলো! একটি আশ্রমের পাশ দিয়েই ছোট্ট পাহাড়টিতে ওঠার রাস্তা। ডাল ভেঙে একটা লাঠি নিয়ে নেবেন তাতে পাথুরে চড়াই ভেঙে উঠতে সুবিধা হবে।বিশাল ও ঘন বৃক্ষরাজির মধ্যে দিয়ে ওঠার সময় খালি মনে হয়,ধুর আর উঠে কি করবো! কিন্তু ওপর থেকে যারা বিজয়ীর ভঙ্গিতে নেমে আসছে তারা খালি বলে "খুব সুন্দর ওপরটা!আস্তে আস্তে যান। " নাবালক পুত্র দেখি হেঁই হেঁই করে উঠে চলে যায়। ওকে সামলাতে আমাকেও তাল মেলাতে হয়।এভাবেই হাঁপ ধরতে ধরতে হাফ পাহাড় উঠে গেলাম। একটা ছোট মন্দির চাতালে জিরোনোর জায়গা আছে।ওখান থেকে চড়াইয়ের রাস্তা ডানদিকে একটা বাঁক নিয়ে ওপরে উঠে গেছে।গিন্নি আর পুত্র দেখি আবার হাঁটা লাগিয়েছে। অনিচ্ছা সত্বেও আমিও পিছু নিলাম। ভাগ্যিস্ উঠেছিলাম! দৃশ্যপটের পরিবর্তন হতে লাগলো দ্রুত,ঘন জঙ্গলের পরিবর্তে ছোটবড় গাছপালা আর রাস্তা হলো আরও পাথুরে।একদিকে খাড়াই ঢাল দিয়ে দূরের সবুজ উপত্যকা মায়াবী লাগছিলো।প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে বেড়ে চলছিল আত্মবিশ্বাস।পদে পদে মনে হলো পরিশ্রম সার্থক,আমিও পারবো।থেমে গেলেই এগিয়ে আসছিল সাহায্যের কচি হাতখানি, আমার পুত্রের। একেবারে পাহাড়চূড়োয় উঠে থামলাম।চারিদিকে পাখির ডাক আর একটি ছোট্ট মন্দির। ৩৬০ ডিগ্রি শুধুই সবুজ আর সবুজ। মনে হচ্ছিল কোনো গ্লানি নেই,কোনো অবসাদ নেই, নেই কোনো দুশ্চিন্তা।এটাই তো সত্যিকারেরর ভ্রমনের সার্থকতা! এখানেই যদি একটা তাবু ফেলে রাতটা কাটাতে পারতাম! মিনিট ১০/১৫ নির্জনতাকে সঙ্গী করে ওপরে কাটিয়ে নামতে থাকলাম।ওপর থেকে নামার সময় একটা গুহার রাস্তা পড়ে। তবে সেটা বড্ড খাড়া।আমি যাইনি।
🔹৩🔹খাঁদারানী লেকঃকিছু বেপরোয়া ছুঁচো ডন দিচ্ছিল পেটে। ভাবলাম খেয়ে নিয়েই খাঁদারানী যাবো।ড্রাইভার বললো একবার বেলপাহাড়ী ফিরে গেলে খাঁদারানী আর আসা হবে না কো। অগত্যা খাঁদারানীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।গাড়রাসিনী থেকে একটুখানি। নামটা শুনে কেউ নাক সিঁটকালে সে মস্ত বড় ভূল করবে। এককথায় অসামান্য।প্রথম দর্শনেই মুখ থেকে বেড়িয়ে আসবে,"Awesome! "আমার তো মনে হলো "বেলপাহাড়ীর ডাল লেক"। অত্যুুক্তি মনে হলে মাফ করে দেবেন।পাহাড় ও টিলাবেষ্টিত বিশাল জলাশয়, পাড়গুলো লম্বা লম্বা ঘাস আর গাছপালা ঘিরে রেখেছে। সূর্যের আলো পড়ে জলে মনি মুক্ত চিকচিক করছে।চড়ুইভাতি করছে একদল কচিকাঁচার দল। খাঁদারানী না দেখলে বেলপাহাড়ী ঘোরা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপ!
*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*
🔹🔹বেলপাহাড়ী বাজারে মধ্যাহ্ণভোজনঃ এবারে মধ্যাহ্ণভোজনের পালা।অবশ্য ঘড়ির কাঁটা ৪টের দিকে ধাবমান,তাই অপরাহ্ণভোজন বললেও ভূল হয়না।বেলপাহাড়ী বাজারের ওপর খাওয়ার হোটেলের বিকল্প সীমিত। আমাদের মেনুও বলে রাখা ছিলো হোটেল অভিনন্দন -এ।মালিক চন্দনদা নিজের হাতে দেশী মুর্গীর মাংস রান্না করেছেন।অপূর্ব সে স্বাদ।উনি নিজেই পরিবেশন করলেন।ডাল,ভাজা,একাধিক তরকারিসহযোগে এই খাঁটি দেশী মুর্গীর মিল ২৫০/-। শেষ পাতে চাটনিও ছিলো। মনে হচ্ছিল হোটেলে নয়,আমরা যেন আমন্ত্রিত হয়ে এসেছি।এসব থেকেই আপ্যায়নের আন্তরিকতাটা সহজেই অনুমেয়।খাওয়ার হোটেল হলেও চা,জলখাবার, মিষ্টি সবই পাওয়া যায় এখানে। অবেলায় ভূড়িভোজের পরে একটা রসগোল্লা ট্রাই করলাম।কিছু বোঝার আগেই মুখের মধ্যে just গলে গেলো।অগত্যা আরও ২ টো নিলাম।আবারও মিলিয়ে গেল।থেকে গেলো স্বর্গীয় এক সুখানুভূতি।ব্যাপারটাকে ভালোভাবে বোঝার জন্য আরও গোটা পাঁচেক রসগোল্লা লাগলো।সুস্বাদু রসগোল্লা চেখে আমার ভেক-ডায়েটিং করা গিন্নিও আমাকে কম্পিটিশনে ফেলে দিয়েছিলো!বিশ্বাস করবেন কি না জানি না এ রসগোল্লা দেবভোগ্য! অনাদরে বেলপাহাড়ীতে পড়ে আছে।কপালে ছিল তাই না পেলাম!শেষ পর্যন্ত মোট কতগুলো খেয়েছিলাম আর নিয়ে এসেছিলাম সবাই মিলে, বলে আর লজ্জা বাড়াবো না!তবে বেলপাহাড়ীর সদাশয় জনগন বিস্ময়নেত্রে আমাদেরকে দেখে গেছে শুধু ।
হোটেল অভিনন্দন এর উল্টোদিকে একটা খাওয়ার হোটেল আছে—"কাঁচালঙ্কা"। বেশ নামটি তাই না!
*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*-*
🔹৪🔹তারাফেনী ড্যামঃ চন্দনদার আপ্যায়ন থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে অব্যহতি নিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটলো তারাফেনী ড্যামের দিকে।তারাফেনী,বেশ সুন্দরী।বেলা পড়ে আসছিল। এরপর যেতে হবে ঘাঘরা।তাই তারাফেনীতে বেশী সময় দিতে পারলাম না।তবে সময় দিতে পারলে তারাফেনী নিশ্চয়ই আরও সুন্দরী হয়ে আমাদের কাছে ধরা দিত।
🔹৫🔹ঘাগড়া নদী সংলগ্ন এলাকাঃ বেলপাহাড়ীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এই স্পটটি ছিলো আমাদের শেষ গন্তব্য। খুব আফশোস হচ্ছিলো জায়গাটিতে যখন এলাম তখন দিনের আলো নিভু নিভু। আমার এক বয়ঃজ্যেষ্ঠ ভ্রমনসাথী আমাকে মৃদু বকা লাগালেন এই বলে যে এত ভালো ভালো স্পট কেন একদিনে সব দেখছি! কেন আরও একটা দিন সময় নিয়ে এলাম না? আফশোষ আমারও হচ্ছিলো বইকি!ঘাঘড়া নদী সংলগ্ন এলাকায় সত্যিই একটা দিন দিব্বি কাটানো যায়। কত যে পিকনিক পার্টি আসে এখানে। যথারীতি নোংরা করে দিয়ে যায়।তারপরেও ঘাঘরা অমলিন রয়ে গেছে।প্রানবন্ত কিশোরীর মত সে উচ্ছল। পাড়ের বালুরাশি যেন তার সুবিন্যস্ত গন্ডদেশ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটবড় প্রস্তরখন্ড তার নানাবিধ অলংকার। আর আবছা আলোয় মাখা চারপাশের জঙ্গল যেন তার অবিন্যস্ত কেশরাজি।ভরা বর্ষায় নিশ্চয়ই সে পূর্ণযৌবনা হয়ে ওঠে। সেই রুদ্ররূপধারিনীকে দেখতে আবার আসতে হবে বই কি! ঘাঘরা কিন্তু সাংঘাতিক নৈসর্গিক।
◼ সময়ের অভাবে যে জায়গাগুলো আমার এবারে দেখা হলো না, আপনারা সুযোগ পেলে দেখে নেবেন।
যেমন, প্রাগৈতিহাসিক লালজল গুহা,ক্ষুদিরামের আত্মগোপনের স্থান এবং অবশ্যই কাকড়াঝোড়া।
https://m.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/3083496295035890/?mibextid=2JQ9oc
℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅℅
◼ যদি আগেরদিনের ঝাড়গ্রাম সফর সম্পর্কে জানতে চান তবে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।👇
https://m.facebook.com/groups/806734166045459?view=permalink&id=3026714530714067
বাকী কথা বলুক ছবিগুলো।
Comments