ঝটিকা সফরে ঝাড়্গ্রাম-বেলপাহাড়ী-কাঁকড়াঝোর-পর্ব ৩// সুমেধা চট্টোপাধ্যায়
ঝটিকা সফরে ঝাড়্গ্রাম-বেলপাহাড়ী-কাঁকড়াঝোর
পর্ব ৩
@ সুমেধা চট্টোপাধ্যায়
প্রকৃতি ও ইতিহাসের মাঝে....
কৃষ গার্ডেন থেকে আমরা ঝাড়্গ্রাম প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র ও আদিবাসী সংগ্রহশালা 'র উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। জায়গাটির নাম বাঁদরভোলা। একটি বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা উঁচু উঁচু শাল সেগুনের জঙ্গল। তারমধ্যে WBFDC র কটেজগুলি। এখন করোনার কারণে বুকিং বন্ধ। তবে আদিবাসী সংগ্রহশালাটি খোলা ছিল। আমরা ক্যাম্পাসের মধ্যেই গাড়ি পার্ক করলাম। জঙ্গলের মধ্যে কৃত্রিম হাতি ও হরিণের পরিবার। হঠাৎ দেখলে গা-ছমছম করে ওঠে। কিছু আদিবাসীরও প্রতিকৃতি করা। আমাদের দেখেই এক ভদ্রলোক কাঁধে তোয়ালে ফেলে এগিয়ে এসে বললেন 'কটেজ বন্ধ'। আমরা যদিও জানতে চাইনি৷ ঘুরতে ঘুরতে আদিবাসী মিউজিয়ামে এলাম। এক ভদ্রলোক খুবই অনিচ্ছা এবং মুখে বিরক্তি নিয়ে বসে আছেন। নজর রাখছেন দুটি বিষয়ে। জুতো খোলা হচ্ছে কিনা। আর বেরোবার সময়ে ফিডব্যাক যেন লেখে সবাই।
মিউজিয়ামটির ভিতর খুব সুন্দর। দর্শনার্থী তেমন না আসার কারণেই মনে হয় আলো কম জ্বালানো এবং এসি চলছিল না। সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি জনজাতির ব্যবহার্য নানা অস্ত্র, পোষাক, বাদ্যযন্ত্র, মুখোশ ইত্যাদি রাখা। তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে সাওঁতাল বিদ্রোহের বিস্তারিত সচিত্র বর্ণনা। শ্রদ্ধায় নত হলাম সিধো-কানহো'র নেতৃত্বে এক অসম যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের বীরত্বের কাছে। শালবনে ঘেরা জায়গাটি খুব পছন্দ হল। ঠিক করলাম পরে কোন এক সময়ে এখানে এসে রাতযাপন করব।
এবার গন্তব্য কনকদুর্গা মন্দির। নির্বিঘ্নেই পৌঁছলাম। গাড়ি পার্কিং ও এন্ট্রি ফি এক জায়গায় জমা দিয়ে এগোলাম মন্দিরের দিকে। কনকদুর্গা মন্দির নিয়ে প্রচলিত আছে নানা গল্পগাথা। আনুমানিক ৫০০ বছরেরও আগে সামন্ত রাজা গোপীনাথ স্বপ্নে আদেশ পেয়ে স্ত্রীর হাতের কাঁকন দিয়ে এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। কনক দুর্গা মন্দির পরিদর্শন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা দেয়। এটি ঝাড়গ্রাম শহর থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূরে। শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরটি ডুলুং নামে একটি ছোট মোহনীয় নদীর পাশে ঘন জঙ্গলে অবস্থিত। বেশ কিছু বিরল প্রজাতির গাছ, পাখি এবং বানর এখানে দেখা যায়। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে স্বল্প সময়ের ভ্রমণ একটি মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা দেয়। প্রসঙ্গত, বানরের উপদ্রবে এখানে মোবাইল, সানগ্লাস ও খাবার খুব সামলে রাখতে হয়৷ দেবী এখানে অশ্বারোহিনী চতুর্ভূজা। স্থানীয়রা বলেন, আগে নাকি এখানে নরবলি হত। দেবীর নির্দেশে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে বলি আজও হয়। পাঁঠাবলি। অষ্টমীর রাতে। মন্দিরের পাশে গভীর জঙ্গলের মধ্যে। নিশা পুজোয় অংশ নেন শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্যরাই। স্থানীয়দের বিশ্বাস , নবমীর ভোগ রান্না করেন স্বয়ং দুর্গা।
মাও আমলে ২০০৭-২০০৮-য়ে দুবার চুরি যায় মূর্তি। নতুন করে তৈরি হয় অষ্টধাতুর মূর্তি। মন্দিরে বসে সিসিটিভি। পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রেও জায়গা করে নেয় কনকদুর্গা মন্দির। মন্দির লাগোয়া বিশাল ভেষজের জঙ্গল। পরিচর্যার অভাবে দামী দামী ওষুধের গাছ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বর্তমানে গাছের রক্ষণাবেক্ষণে রাখা হয়েছে রক্ষী। তৈরি হয়েছে চেকপোস্ট।
মূল মন্দিরের পাশেই ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের অংশবিশেষ। তার পাশ দিয়েই জঙ্গলে ঘেরা রাস্তা দিয়ে ডুলুং নদী যাওয়ার পথ। বর্ষাকালে আসার দরুণ, যে নদী হেঁঁটে পারাপার করা যায় তার এক ভয়াল রূপ আমরা দেখলাম। অন্যপারে অনেকে স্নান করছে। সৌমিত্র নীচে নেমে কয়েকটি ছবি তুললো।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। এবেলার শেষ গন্তব্য চিল্কিগড় রাজবাড়ি এলাম আমরা। এখানে 'দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন' সিনেমাটির শুটিং হয়। আমরা গিয়ে যখন পৌঁছলাম সূর্যের আলো সামান্য যেন মৃয়মাণ। আলো-আঁধারিতে রাজবাড়ির আনাচ-কানাচ কেমন যেন গা-ছমছমে হয়ে উঠেছে।
বড় রাস্তার উপরেই রাজবাড়ী প্রবেশের বড় তোরণদ্বার, ঢুকেই একটা উন্মুক্ত প্রান্তর, বাঁদিক একটা প্রাচীন বৃহৎ অশ্বত্থ গাছ, তার পাশ থেকে একে একে চোখে পড়ল তিনটি মন্দির, পরিত্যক্ত সার্ভেন্ট কোয়ার্টার ও আউটহাউস এবং ডাইনে মূল রাজপ্রাসাদ। বেশ সুন্দর মনোরম পরিবেশ।
প্রায় কয়েকশো বছর আগে জামবনীর রাজা ছিলেন ভূমিপুত্র সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ এবং চিল্কিগড় ছিল তার রাজধানী। চিল্কিগড়ের প্রাচীন কনকদূর্গা মন্দির এবং এই রাজবাড়ীটি রাজা গোপীনাথ সিংহের আমলেই তৈরি। পুত্রহীন রাজার একমাত্র কন্যা সুবর্ণমণির সাথে পরবর্তীকালে বিবাহ হয় পার্শ্ববর্তী ধলভূমগড়ের রাজা জগন্নাথ (সিংহ) দেও ধবলদেবের সাথে। ১৭৬৫ সালে রাজা গোপীনাথ সিংহের মৃত্যুর পর চিল্কিগড়ের রাজা হন জগন্নাথ সিংহ। ওনাদের পুত্র কমলাকান্ত দেও ধবলদেবের সময়কে চিল্কিগড়ের স্বর্নযুগ বলে মনে করা হয় তবে এই রাজবাড়ীর সাথে আরো একটি ইতিহাস জুড়ে আছে ওতপ্রত ভাবে। ঐতিহাসিক চুয়াড় বিদ্রোহ চলাকালীন রাজা জগন্নাথ সিংহ এই চিল্কিগড় রাজবাড়ী থেকেই ১৭৬৯ সালে ধল বিদ্রোহের ঘোষণা করেন, দুঃখের কথা এই যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কড়া হাতে এই বিদ্রোহ দমন করতে সফল হয়।
বর্তমানে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত না হলেও সর্বত্র অবহেলার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই রাজবাড়ী। মূল প্রাসাদে রাজবাড়ীর বংশধরেরা বসবাস করেন, সেখানে প্রবেশ নিষেধ। এই জায়গাটি সদ্য সংস্কার করা হয়েছে বুঝতে পারলাম। মুঘল ও ব্রিটিশদের মিলিত স্থাপত্যশৈলীতে তৈরী দ্বিতল এই রাজবাড়ীর দেওয়ালে অন্যান্য কারুকার্যের সাথে বাংলার শিল্পকলার কাজও চোখে পড়ে, বাইরে থেকে একনজর দেখেই বোঝা যায় কি রকম এর জৌলুশ থেকে থাকবে এক সময়ে।
চত্ত্বরের ভেতরে থাকা মন্দির তিনটির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়, এর মধ্যে সবথেকে বড় নবরত্ন মন্দিরটি রাধা কৃষ্ণের, প্রধান ফটকের পাশের মন্দিরটি শিবালয়।
এই রাজবাড়ির মূল ফটকের ঠিক আগেই ডুলুং নদীর ওপর দিয়ে পিচরাস্তা। জায়গাটি দারুণ সুন্দর। সিদ্ধার্থ আগেই জানিয়েছিল বেশি বৃষ্টিতে এই রাস্তা ডুবে যায়। স্রোত দেখে সে কথা যে সত্য তা বেশ টের পেলাম।
স্বভাবতই সবার পেটে এবার ছুঁচো ডন দিতে শুরু করেছে। ডান হাত নিশপিশ। থাকার জায়গায় ফোন করে জানানো হল আমরা খেয়ে নিয়েই একদম ঘরে যাব। বিকেলে গন্তব্য চিড়িয়াখানা। তবে আকাশ বেশ কালো করে এল। আমরা অবশ্য বৃষ্টি নামার আগেই আমাদের রাতঠিকানায় ঢুকে পড়লাম। গরম ধোঁয়া ওঠ ভাত, তরল ঘি, ডাল, ঝুরি আলুভাজা, স্যালাড, কাতলা মাছের ঝাল, চাটনি এবং শেষ পাতে এক দারুণ স্বাদের দই। ঘরে পাতা দই এর মতো খেতে হলেও জানা গেল এটি কেনাই।
ঝুল বারান্দা যুক্ত দুটি বেশ সুন্দর ঘর। ঠিক হল স্নান সেরে আমরা বিশ্রাম আর নেব না। কারণ ৬টায় চিড়িয়াখানা বন্ধ হবে। অতএব এক সেট নতুন ড্রেসে সবাই এবার একটা গাড়িতে উঠলাম। খান কতক ছাতা। বৃষ্টি নেমেছে বেশ।
পরের পর্বে জনমানবহীন চিড়িয়াখানায় মাত্র কয়েক হাত দূর থেকে এক রাগী চিতাবাঘের সাথে কথোপকথনের গল্প।
তথ্য সূত্র- কিছু ট্র্যাভেল ব্লগ ও অন্তর্জাল।
পর্ব ১ঃ
https://www.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/4905216262863875/
পর্ব ২ঃ
https://www.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/4914755501909951/
Comments