বেলপাহাড়ীর আনাচে কানাচে.....@ ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
বেলপাহাড়ীর আনাচে কানাচে.....
@ ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
এবারের পুজোয় কোভিডের ভয় জয় করে কাছেপিঠে কোথায় যাওয়া যায় এই নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে করতে বেলপাহাড়ী যাবার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললাম | বেলপাহাড়ী ঝাড়গ্রাম জেলার একটি প্রান্তীক মফস্বল অঞ্চল যার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী যথেষ্ট আকর্ষণীয় | পাহাড় ঘেরা অরণ্য, সরল আদি অধিবাসী, ঝর্ণা আর আমাদের মত শহরবাসীদের কাছে অক্সিজেনের ভান্ডার এই জায়গাটি বাঁকুড়া জেলার মুকুটমনিপুর, ঝাড়খন্ডের ঘাটশিলা ও উড়িষ্যার প্রান্তসীমায় অবস্থিত |
কোলকাতা থেকে বেলপাহাড়ী সড়কপথে যাবার তিনটি রাস্তা আছে |
মুম্বাই রোড ধরে খড়গপুর হয়ে লোধাশুলির জঙ্গল পেরিয়ে ডানহাতি চিছড়ার পথ ধরে সোজা বেলপাহাড়ী | দূরত্ব প্রায় ২১০ কিলোমিটার |
মুম্বাই রোড ধরে খড়গপুর থেকেই ডানদিকে মেদিনীপুর, গড়বেতা হয়ে | দূরত্ব প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার |
আর ডানকুনি থেকেই ডানদিকে চন্ডীতলা, আরামবাগ, জয়রামবাটী, বিষ্ণুপুর হয়ে | দূরত্ব প্রায় ২৬০ কিলোমিটার |
ট্রেনপথে কাছাকাছি স্টেশন ঝাড়গ্রাম | বা ঘাটশিলা হয়েও আসতে পারেন | তবে দুটি ক্ষেত্রেই আপনাদের স্টেশন থেকে গাড়ী নিতে হবে |
আমরা ৬ জন মহাষ্টমীর সকাল ৬ টায় একটি ৬ সীটের ভাড়া করা শেভ্রোলেতে যাত্রা সুরু করলাম, প্রথম বলা যাত্রাপথটি ধরে | গাড়ীর মালিক এবং চালকের নাম শ্রী বীরেন্দ্র ঝা | যোগাযোগ: ৯৭৪৮৮৩৫৫৮০ | গাড়ী রুবি আনন্দপুর অঞ্চলের | ঝা জীর মত ভদ্র মাটির মানুষ গাড়ীচালক আমি দ্বিতীয় দেখি নি | নিরামিষাশী ধর্মপ্রাণ নিরীহ চাহিদাহীন আধুনিক যুগের অনুপযোগী এক অদ্ভূত মানুষ | তাঁকে সারথী হিসেবে পেয়ে আমরা সত্যিই আপ্লুত ছিলাম |
কোলকাতার দিক থেকে আমরা যখন যাই তখন প্রাতঃরাশটা কোলাঘাটের নিউ মা তারা হোটেল এ করে থাকি | এবারও তার ব্যাতিক্রম করলাম না | খাবার সময় ছেড়ে মোটামুটি সাড়ে ৪ ঘন্টায় পৌঁছোলাম বেলপাহাড়ীতে | বেলপাহাড়ীর এসপ্ল্যানেড হল ইন্দিরা চক | ঐ চক থেকে বাঁহাতি একটি পথ, নাম SBI রোড, তা ধরে কিছুটা গেলে আমাদের হোম স্টে | নাম বাগানবাড়ী | মালিক শ্রী সমীর তেওয়ারী ( ৮৯২৭৬৪২৫৭৫) অতি সজ্জন মানুষ | দীর্ঘদীন বসবাস করছেন বেলপাহাড়ীতে | তাই তাঁকে নিয়ে বেড়াতে গেলেই ভাল হত | দ্রষ্টব্য জায়গা গুলি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান অগাধ | কিন্তু আমাদের গাড়ীর স্থানাভাবের কারনে তা আর সম্ভব হল না | যদিও তিনি আমাদের দিশে দেখিয়ে দিয়েছিলেন নিপুনতার সংগে | বাগানবাড়ীর বানিজ্যিক দিকটি দেখাশোনা করেন তাঁর বড়মেয়ে শ্রীমতী সুমনা তেওয়ারী মিশ্র | যোগাযোগ: ৭৫৪৭৯২৮২০২. সদাহাস্যময়ী, শিক্ষিতা, নম্র এবং অতিথিবৎসলা | বাপ বেটীর ব্যবহারে প্রীত হলাম | তিনতলায় তিনটি বেশ বড় ঘরের একটি ফ্ল্যাট হল এই হোম স্টে টি | সংগে একটি বড় খাবার ঘর ও একটি রান্নাঘর | একটি ঘরের সংগে সংলগ্ন বাথরুম | অন্য বাথরুমটি ফ্ল্যাটের ভেতরে কিন্তু ঘরের সংগে সংযোজিত নয় | প্রত্যেকটি বাথরুম আধুনিক সুবিধাযুক্ত এবং ইংরিজী ধাঁচের | ঘর এবং বাথরুম নিয়মিত পরিস্কার হয় | ঘরগুলি প্রত্যেকটি প্রশস্ত এবং যথেষ্ট আলোবাতাস যুক্ত | সারাদিন পায়ে হেঁটে পাহাড় ঘোরার পর বাগানবাড়ীতে এসে মনে হবে যেন নিজের বাড়ীতে এলাম | এই হোম স্টে টি একেবারে নতুন | এঁরা এটিকে আরও আরামদায়ক করে তুলছেন ক্রমশ | আমরা চা ছাড়া এখানে কিছু খাই নি | তাই খাবারের বা রান্নার মান সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না |
ঠিক ইন্দিরা চকের দুপাশে দুটি খাবার হোটেল আমাদের দুপুর ও রাতের খাবারের চাহিদা মিটিয়েছে | একটি বহুশ্রুত কাঁচালঙ্কা | দামটি একটু বেশী | তবে পদের সংখ্যা, খাবারের স্বাদ ও দোকানটির কর্ণধার, সাহেবের ব্যবহার অতুলনীয় | উল্টোদিকে অভিনন্দন ও অভিনন্দনযোগ্য | পদের সংখ্যা কাঁচালঙ্কার তুলনায় কম | দামও অনেক কম | রান্নার স্বাদ উনিশ বিশ | সন্ধেবেলায় খাবারের অর্ডার ও অগ্রিম দিয়ে গেলে দুটি হোটেল থেকেই বাগানবাড়ীতে রাত্তিরের খাবার পৌঁছে দেয় | তবে প্রাতঃরাশ শুধু অভিনন্দনেই পাবেন এখন | কাঁচালঙ্কা এখনও শুরু করে নি | দুটি দোকানের ই ছবি নিচে দিলাম |
বেলপাহাড়ীতে বেড়ানোর জায়গা অনেক | তাই দিক অনুযায়ী জায়গাগুলিকে ভাগ করে না নিলে অযথা সময় নষ্ট হতে পারে | একটি দিনের দ্বিতীয় অর্ধে দেখে নেওয়া যায় ঘাগরা জলপ্রপাত ও তারাফেনী ড্যাম | এরা একই দিকে, কাছাকাছি | তবে দুটি দেখেই হতাশ হবেন | কালী মন্দিরের পাশ দিয়ে যাবার রাস্তা | ইন্দিরা চক থেকে দুটি দেখে ফিরে আসতে খরচ হবে ২২ কিলোমিটার মত |
পরের দিন ভোরে উঠে চলে যান গাড়রাসিনি পাহাড় ও খাদারহানি লেক | দুটিই সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৪ টে পর্যন্ত খোলা থাকে | এরা পাশাপাশি, একই দিকে | গাড়রাসিনি হেঁটে উঠতে হবে | খানিকটা উঠে একটি মন্দির, তারপর আরও চড়াই ভেঙে চূড়োয় মহাদেব | দৃশ্য বেশ সুন্দর | ওঠার ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় | ওঠা নামায় সময় যাবে ঘন্টা দেড়েকের মত | পাদদেশে বাবাজী মহারাজের শিষ্য জগদানন্দজী গিরির আশ্রম | একবার ঘুরে আসবেন | এবার কিছুটা গাড়ী করে গিয়ে লেক | ভারী মনোরম পরিবেশ | বেড়ানো সার্থক | পথে কোথাও দুপুরের খাবার পাবেন না | তাই চলে আসুন আবার সেই ইন্দিরা চক | মোট খরচ হল ২৭ কিলোমিটারের মত | অল্প করে খেয়ে নিয়ে চলুন, দেখে আসি ভাঙিকুসুম, কোটনি জলপ্রপাত আর কাঁকরাঝোড় বাঁধ | এরা আবার একই দিকের পথিক | ভাঙিকুসুম প্রথম পড়বে | গাড়ী থেকে নেমে বেশ খানিকটা হাঁটা | পেট ভরে খেলে আর পারবেন না | জঙ্গলের ভেতরে ঝর্ণা | পরিবেশ সুন্দর | এরপর কোটনি | জল আছে কিছুটা, কিন্তু প্রপাতশূণ্য | একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে | নাহলে কাঁকরাঝোড় পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে | আর কিছু দেখা যাবে না | কাঁকড়াঝোড় থেকে ঘাটশিলা যাবার রাস্তায় ঐ বাঁধটি | ড্যাম হিসেবে আহামরি কিছু নয় | কিন্তু প্রকৃতি এখানে অকৃপণ | স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে | নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয় | কি জানি কোথায় যেন অহংটি হারিয়ে যায় | সময় পেলে আরও একটু এগিয়ে ডানহাতে আরও গভীর জঙ্গলে হারিয়ে যেতে পারেন | আমরা সে সময় পাই নি | মোট ৬৬ কিলোমিটার মত ঘুরে এলেন | পরের দিন কোলকাতা ফেরার দিন | বিজয়া দশমী | বাগানবাড়ীকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পরলাম | বেরিয়েই বাঁদিকে গেলে পাওয়া যাবে সাদাপাহাড় | এ এক আশ্চর্য ধবধবে পাহাড় | চমৎকার দেখতে | এত ঘুরেও যদি আপনার হাঁটুর জোর থাকে তো চলে যান কানাইসহর পাহাড় এ | এক ই দিকে | আমরা দুর্বল হাঁটু বাঙালী | তাই আর যাই নি | তবে শুনলাম যে ওপরে উঠতে নাকি সময় লাগবে প্রায় দুঘন্টা | আর একদম চূড়োয় হেঁটে উঠতে না পারলে গিয়ে লাভ নেই | কিছুই দেখতে পাওয়া যাবে না | এবার ফেরার পালা | আমরা ঠিক করেছিলাম যে আসার পথে ৫৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মুকুটমনিপুর ঘুরে আসব | পথে পড়বে আরও এক দ্রষ্টব্য লালজল পাহাড় ও গুহা | এখানে এক মন্ত্রসিদ্ধ সাধুবাবা বাঘের সংগে বসবাস করতেন | তাঁর মহাপ্রয়াণ হয়েছে | গুহাটি দর্শনীয় |
আমাদের ভ্রমন ছিল দুরাত, তিন দিনের | সংগে গাড়ী ছিল সর্বক্ষণ | মাথাপিছু খরচ পড়েচে মোটামুটি ৪২০০/-. আপনাদের সুবিধার্থে দিলাম | একটা অনুমান করতে পারবেন |
এখনকার জঙ্গল পাহারাদারেরা কয়েকদিন আগেই মাও এর সেবাদাস ছিলেন | তাই কম কথা বলবেন তাঁদের সংগে | প্রয়োজন না থাকলেও বাজেট অনুমতি দিলে স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে কিছু কিনতে পারলে ভালো হয় আর মনে রাখবেন, আপনি বেলপাহাড়ীতে, পার্কষ্ট্রীট এ নেই | তাই সব পাবার বাসনা রাখবেন না | যান না, এই শীতে ঘুরে আসুন | নিরাশ হবেন না |
https://m.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/4862137627171739/?mibextid=2JQ9oc
Comments