JOURNEY THROUGH THE WOODS # বিধান তুঙ্গ

# JOURNEY THROUGH THE WOODS #
                       বিধান তুঙ্গ
গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনেছেন কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না তবুও বৃষ্টি পড়ার শব্দ নিশ্চয়ই শোনা হয়নি ??        

এই সময় শালের জঙ্গলে এলে শুনতে পাবেন বৃষ্টির শব্দ ! ঝরে পড়া পাতার উপর বৃষ্টির ফোঁটার মতোই পড়ে চলেছে শালের ফুল। হওয়ার দোলা লাগলেই গোটা জঙ্গল জুড়ে বৃষ্টির শব্দ। 
দলমার হাতিরা নাকি কুখ্যাত ! দলে দলে এসে তাণ্ডব চালিয়ে যায় ক্ষেতে, গ্রামে। কখনও মহুল বনে গিয়েছেন, মহুল ফল পাকার সময়ে ?? 
হলুদ বর্ণের ছোট ছোট ফল বিছিয়ে থাকে বনস্পতির তলদেশে। মাতাল করা গন্ধে পাগল পাগল লাগে। হাতিদের আর দোষ কী ? মানুষই নিজেদের সামলাতে পারে না তো হাতি ! নেশায় বুঁদ হয়ে ওঠে হাতি থেকে মানুষ। 
 পিঙ্গল বর্ণের ছায়া নিবিড় মেঠো পথ। পাহাড়, অরণ‍্যাণি, নদী, ঝর্ণা, পাখির কলকাকলি, বন্য প্রাণীর গা শিউরে ওঠা আর্তনাদ... কী নেই !
       কলকাতা থেকে মাত্র 170কিমি দূরে বাংলার 22তম জেলা ঝাড়গ্রাম। সদ্য পরীক্ষার ফাঁস থেকে মুক্ত সন্তান ও পরিবারকে অক্সিজেন দিতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। মাখনের মত মসৃণ পথে (না! কোলাঘাটের শের-ই-পাঞ্জাবের হাতছানি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়) 3.5 ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম ঝাড়গ্রাম প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রে অর্থাৎ forest rest house এ। ইচ্ছে ছিল নবাবের ভঙ্গিতে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ীর অতিথিশালায় পদধূলি দেব কিন্তু পকেটের কথা ভেবে জঙ্গলেই আতিথেয়তা গ্রহণ করলাম। রাঁধুনি সঞ্জয়দার হাতে দুপুরে কচি পাঁঠার ঝোল খেয়ে একটু পিঠ সোজা করে নিলাম। শালের জঙ্গলে কত পাখির কলকাকলি শোনা যাচ্ছে। মনে মনে স্বপ্ন দেখছি!
       কি অদ্ভুত দৃশ‍্য ! জঙ্গল ভেঙ্গে তছনছ করে ছুটে আসছে হরিণের দল। কান উঁচু করে খরগোশ দৌঁড়ে চলেছে। এক ঝাঁক বুনো টিয়া সোঁ সোঁ করে আকাশ পানে উড়ে গেল। সবাই প্রাণ ভয়ে যায় কোথায় ? ঘোর কাটল কিছু পরেই... উন্মত্ত মাতঙ্গের দল বেঁধে এগিয়ে আসছে....! কোথায় যেতে চায় এরা ?? কোথায়?.....ঝাড়গ্রামের রানি "বেলপাহাড়ির জঙ্গলে"!
সে আগামী কাল আমরাও যাব... তার আগে শেষ বিকেলে দেখে নিলাম এই প্রাচীন শহরকে
          @ ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি:
আনুমানিক 1570 সালে মুঘল সম্রাট আকবরের আদেশে রাজস্থান থেকে সর্বেশ্বর সিং চৌহান বাংলা জয় করতে আসেন। এই অঞ্চলের গভীর অরণ্যে বসবাসকারী মাল রাজাদের পরাজিত করে মল্লদেব উপাধি ধারণ করেন, শুরু করেন রাজত্ব। রাজা সর্বেশ্বর এইখানে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন যার রাজধানী হল ঝাড়গ্রাম। প্রায় 400 বছর ধরে 18 জন রাজা এই রাজত্বে রাজকার্য পরিচালনা করেছেন।1931 সালে ইউরোপীয় ও মুসলিম স্থাপত্যের সংমিশ্রনে বর্তমান রাজপ্রাসাদটি স্থাপিত হয়।
প্রাসাদের নিম্নতল বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগ ও রাজপরিবারের যৌথ পরিচালনায় হেরিটেজ হোটেলে পরিণত হয়েছে। জঙ্গলমহল বেড়াতে এসে রাজবাড়ীতে রাত্রি যাপন করতে পারলে বেড়ানোর স্বাদ অন্য মাত্রা পাবে নিঃসন্দেহে ! আপনি ছুঁয়ে নিতে পারবেন সেইসব বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্পর্শে ঋদ্ধ বাড়িটিকে। কে নেই? পরাধীন ভারতের ভাইসরয়-গভর্নর ছাড়াও স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজাগোপালাচারী থেকে প্রণব মুখার্জি, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, মোরারজি দেশাই; প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।রাজ বাড়িটি ফরেস্ট বাংলোর কাছেই অবস্থিত।
শেষ বিকেলে ঘুরে নিলাম ডিয়ার পার্ক। জঙ্গলে ঘেরা এই পার্কটি ছোটদের কাছে খুবই উপভোগ্য। অসংখ্য হরিণের সাথে সাথে নীল গাই, ভাল্লুক, নেকড়ে, হায়না, সাপ ,এমু প্রভৃতি বন্য প্রাণী রয়েছে। । বনবাংলো থেকে গাড়ি বা টোটোতে ঝাড়গ্রাম রেল গেট পেরিয়ে ডানহাতি রাস্তা ধরে কিছু দূরেই অবস্থিত। সাবিত্রী দেবীর মন্দির ঘুরে দেখা যেতে পারে। অবশ্যই দেখে নেবেন চিল্কিগড় রাজপ্রাসাদ, কনকদুর্গা মন্দির। 

ঝাড়গ্রামের আশেপাশের দ্রষ্টব্য আগেও দেখেছি কিন্তু জঙ্গলমহলের রানীকে দেখা হয়ে ওঠেনি। আগামীকাল দেখব বলে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছিলাম।
----//----//--//------///-
সকাল সকাল প্রাতরাশ খেয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এলেও স্থানীয় অপরিচিত ও দর্শনীয় স্থানগুলি সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সারথি শান্তনুর উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম। অতন্ত্য বিনয়ী, মৃদুভাষী ,দক্ষ সারথি পেয়ে খুশিই হলাম। বনবাংলো থেকে অতীব সুন্দর SH5 রোড ধরে এগিয়ে চললাম বেলপাহাড়ী পথে...
     
@কাঁকড়াঝোর:                                         
  ঝাড়গ্রাম থেকে বেলপাহাড়ি দূরত্ব 41 কিমি।
  বেলপাহাড়ী থেকে শিলদা, ভুলাভেদা , ওদলচুয়া হয়ে কাঁকড়াঝোরের দূরত্ব 34 কিমি । বন্ধুর চড়াই-উতরাই, দু’পাশে গহীন বনভূমি। মানুষজনের দেখা খুব একটা মেলে না এই পথে, নির্জনতাই বড় প্রাপ্তি।কাঁকরাঝোর যেতে যেতেই পথিমধ্যে দেখে নিলাম “কেটকি ঝরনা”।বেলপাহাড়ী থেকে 14 কিমি। ছোট্ট একটা বাঁক ঘুরতেই আদিবাসী গ্রাম চোখে পড়ল। গ্রামকে বাঁদিকে রেখে ডানদিকের রাস্তায় একটু যেতেই পাথুরে পথ হয়ে দাঁড়ালো বিপদ্জনক। ভাবছি! এই পথে গাড়ী নিয়ে গেলে আটকে যাব না তো ?

- এ বাবু, ইধার দিয়ে যাচ্ছিস ক্যানে ! গেরামের মধ্যি দিয়ে সিধা যা...
    মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে বয়স্কা আদিবাসী মহিলা। আলাপ জমিয়ে জানতে পারলাম ওনাদের জীবন ও জীবিকা ও সম্পর্কে। চারিদিকে মহুয়া গাছে ঢেকে রয়েছে, সঙ্গে মাতাল করা সুবাস। 
-- মা রে ! এতো মহুয়া ফল শুকিয়ে কি হবে ? শুধুই কী নেশা করার জন্য !
--না বেটা ! ফল শুকিয়ে রাখা হয় পশুর খাবারের জন্য। 
শুকিয়ে নিলে কিসমিসের মতো লাগে। সাবান হয় নাকি এর তেলে! মহুল ফলের খইল(খোল) পশু খাদ্য, মানুষও খায়। কাঁচা ফল বেশী খেয়ে ফেললে হাতি পর্যন্ত নেশায় বুঁদ হয়ে মারা যেতে পারে !
সব বাড়ির উঠোনে রাশি রাশি মহুল ফল শুকনো হচ্ছে। মহুলগাছের তলা থেকে, ঝুড়ি ভরে বাচ্চা-বুড়ো সবাই ফল সংগ্রহ করছে। 
            গ্রাম ছাড়িয়ে 500 মিটার গিয়েই পেলাম একটি জলাশয়। ঝর্নার দেখা পেলাম না। ফিরতি পথে দেখা হল বয়স্ক মানুষ সরোজ মুর্মুর সাথে। 
-- কেন্দু ফল খাবি ?
--খায় নাকি ?
--ক্যানে খাবে না ! মিঠা ফল আছে।
                      পাঁকা কেন্দু ফল খেতে দিল।খেতে বেশ মিষ্টি মিষ্টি , অনেকটা গাবের মতো।
--ঝর্না কোথায় ?
--একুন কতায় পাবি! বৃষ্টি হলে দিখা যায়।তকুন বিল জলে ভরে যায়।
--সামনের পাহাড়ের নাম কি ?
--চেরেং পাহাড়।

আক্ষেপ করছিলেন, " সরকার এই জলাশয়টি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বহুদিন আগে জরিপ করে গেছে কিন্তু এখনও ফলপ্রসূ কিছু হয়নি।" বর্ষায় জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেলেও ঢালের কারণে জল থাকে না। জল পেলে এই অঞ্চলের কৃষকরা উপকৃত হবে।

এগিয়ে চললাম কাকড়াঝোর এর উদ্দেশ্যে। 
  দূরত্ব 24 কিমি ।পথ মাঝে পড়ে ময়ূর ঝর্না। না! কোনও ঝর্না নেই।সংরক্ষিত হাতির অরণ্য ।দেখে নিতে পারেন।ঝাড়খণ্ড সীমানার নিকটে একটি পাহাড় ঘেরা অরণ্য ভূমি। ‘কাঁকড়া’ শব্দের অর্থ পাহাড়। ‘ঝোর’ শব্দের অর্থ অরণ্য। ৯০০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে রয়েছে স্থানটি । বনানীর মধ্যে কুসুম, শাল, সেগুন, মহুয়া, আকাশমণি গাছ। এখানে কাজু, বাদাম,কফি ও কমলালেবুরও চাষ হয়। থাকার জন্য ছিল বন দফতরের পর্যটক আবাস। 2004 সালে মাওবাদী হানায় পর্যটক আবাসের কিছু অংশ উড়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে বুকিং বন্ধ রয়েছে । মাও হানা পরবর্তী সময় থেকে পর্যটক আসা প্রায় বন্ধ । বর্তমানে এখানে রয়েছে সিআরপিএফের একটি ক্যাম্প। নদীর ওপারে ঝাড়খন্ড ,ঘাটশিলা মাত্র ২২ কিমি। 
   
কাঁকড়াঝোরের চারিপাশ ঘন জঙ্গলের পরিপূর্ণ হওয়ার কারণে বন্য প্রাণীর প্রাচুর্য রয়েছে । কী নেই ? বুনো শূয়োর, হাতি, ময়ূর,বন্য মুরগী, শিয়াল, খরগোশ, হায়না প্রভৃতি। গাছের মধ্যে শাল, সেগুন, আকাশমণি, মহুয়া, পলাশ প্রভৃতি । গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে নদী, রয়েছে কিছু চাষের জমি; গাছে আছে হাতি তাড়ানো ঘর, লতা পাকানো সিঁড়ি । ধানের সময় গ্রামের লোকেরা পালা করে পাহারা দেয় হাতী-ঘরে বসে ।
 বাসে করে ঝাড়গ্রাম থেকে সরাসরি বেলপাহাড়ী হয়ে কাঁকরাঝোর যাওয়া যায় । তবে আরও সহজ পথ হল ঘাটশিলা থেকে পাঁচ-সাতশ টাকায় ৪-৫ জন নিয়ে ছোট গাড়ি আসে কাঁকরাঝোরে। থাকার জন্য গোপীনাথ মাহাতোর মাটির দোতলায় বড় হল ঘর। থাকা খাওয়া দুই মিলবে এইখানে । মিলবে লুচি-তরকারি; দেশী মুরগীর মাংস ।মহুয়ার স্বাদও নিতে পারেন!
    
@লালজল পাহাড় :

কাঁকড়াঝোর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম লাল জলের উদ্দেশ্যে। দূরত্ব 11কিমি। শুরু থেকেই সারা পথ জুড়েই অপূর্ব সব নামের গ্রাম... কানি মূহুলি, ওদলচুয়া, সরিষাবাসা, শুসনিজবি, বুড়িঝোর, ছুড়িমারা, চাকডোবা, শিয়াড়বান্দা। অপূর্ব গ্রামগুলির পরিচ্ছন্ন ও সাজানো বাড়িগুলি দেখতে দেখতেই লাল জল পৌঁছে গেলাম। শেষের দিকে রাস্তাটুকু বেশ খারাপ। না কোন লালজল পেলাম না! আবহবিকার এর ফলে সৃষ্ট নাতি উচ্চটিলা।এই টিলার নীচে নাকি রয়েছে দীর্ঘ গুহা। এই অঞ্চলের জলে নাকি দূর্লভ খনিজ মিশ্রণে লাল জল তৈরি হত বলেই এই নাম ।গুহায় রক্ষিত আদিবাসীদের প্রাচীন অস্ত্র-শস্ত্র বর্তমানে কলকাতা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। এখানকার গুহা ও পাথরে প্রাচীনকালের খোদাই করা মূর্তিও নাকি দেখা যায়!প্রচুর সজারু রয়েছে বলে শুনলাম। সময় অভাবে দেখা হল না । লাল জল দেবী এখানে পূজিত হন। চৈত্র সংক্রান্তিতে এখানকার মণ্ডপে জাঁকজমকপূর্ন ভাবে বাসন্তী পূজা হয়। এখন তারই প্রস্তুতি চলছে। 
     এখান থেকে চলে যেতে পারেন 11কিমি দূরে ঝিলিমিলিতে। বসন্তে এখানকার পলাশ বনে ফুলের আগুন ধরিয়ে দেয়। গাছ বাড়িতে থাকার আনন্দ ও অভিজ্ঞতা লাভ করতে থাকতে হবে রিমিল লজে ।

@ খাঁদারানী লেক ও গাড়রাসিনি শৃঙ্গ :
          লাল জল দেখে উপস্থিত হলাম এই অঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দর জলাশয় খাঁদারানী। পাহাড় দিয়ে ঘেরা প্রায় 500 হেক্টর জায়গাকে 2005 সালে পশ্চিমবঙ্গের সেচ দপ্তর জলাশয়ে রূপান্তরিত করেছে। আমলাশোল মৌজার প্রায় দশটা গ্রাম বর্তমানে উপকৃত । কাক চক্ষুর মতো জল, পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি জলের মধ্যে দুলে দুলে উঠছে। শীতকালে এখানে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী পাখি আসে। কিছু পাখি এখনও দেখতে পেলাম। স্থানীয় আদিবাসীদের কাছে এই জলাশয়ের জল পবিত্র। ঘাটশিলার বুরুডি লেকের থেকে এর সৌন্দর্য কোন অংশে কম নয়!
    এগিয়ে চললাম জলাশয় থেকে অল্প দূরেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু গাড়রাসিনি পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লাল মোরামের পথ। দূর থেকেই পাহাড়ের মাথায় শিবের মন্দির দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে সত্যানন্দ সন্ন্যাস আশ্রম। স্বামী শ্রীমৎ জগদানন্দ মহারাজ এর প্রতিষ্ঠাতা। এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ছাড়াও ভিন রাজ্যের শিষ্যদের ক্রিয়াযোগের মাধ্যমে জটিল সংসার ধর্মের দুঃখ, কষ্ট থেকে পরিত্রাণের হদিশ দেন। 
পরিবার ঘাড় তুলে শৃঙ্গদেশে মন্দিরের অবস্থান দেখে নিজেকে নিবৃত্ত করল। আমার জন্য বরাদ্দ হল মাত্র আধঘন্টা।
--একি মামদোবাজী নাকি ! এত উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে সময় লাগে না !
-- খিদে পেয়েছে । অনেক পাহাড় চড়েছ আর না উঠলেও চলবে !
--এ আবার কি কথা ! এসে দেখব না। চেষ্টা করব সময়ে ফেরার।
দ্রুত পায়ে চলতে শুরু করলাম। বুঝলাম বয়স বাড়ছে তাই পাল্লা দিয়ে বুকে হাপরের টান, জীভ বার করেই গন্তব্যে এগিয়ে চললাম। শাল, পিয়াশাল, মহুয়া, কেন্দুর ছায়া ঘন পাথুরে ও পাতা বিছানো রাস্তায় নিজের পায়ের শব্দেই চমকে উঠছিলাম। বনস্পতির দেহে ভালবেসে জড়ানো লতার আদুরে স্পর্শ পেতে হরেক রকমের পাখি লুকোচুরি খেলছে।
   অল্প সময়ের মধ্যেই উঠে এলাম শীর্ষের মধ্যবর্তী গিরিশিরায়। এখানে রয়েছে বাবা বাসুদেবর মন্দির। চত্ত্বরে অল্প বিশ্রাম নিয়ে ঘাস লতাপাতা মাড়িয়ে পৌঁছে গেলাম চূড়ায়। বাসুদেব মন্দির থেকে গিরিশিরা ক্রমশ খাড়া পথে শীর্ষে উঠে গেছে। মোক্ষনাথ বাবার দেখা পেলাম চূড়ায় যা নীচ থেকে দৃশ্যমান হচ্ছিল। আদিগন্ত সবুজ মখমলের আলোয়ান জড়ানো দৃশ্যপট,গাঢ় নীল আকাশ, শরীরে নির্মল হওয়ার মাখামাখি। বহু নীচে ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম, শীর্ণকায় নদী, পাহাড়ের সারি দৃশ্যমান।
 মন্দিরে মাথা ঠুকে গুহার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম। একটু নিচেই দুটি গুহা রয়েছে। একটি যথেষ্ট বড়। গ্রানাইট শিলায় আবহবিকার এর ফলে বড় বড় ফাটল গুহার সৃষ্টি করেছে। চামচিকি, বাঁদুর বা বন্য হিংস্র জন্তুর বাসভূমি হতে পারে। এখানের কোথাও গাডরাসিনি দেবীর নাকি অধিষ্ঠান রয়েছে। এখানে আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবার(মধ্য জুলাই) ধুমধাম করে এই দেবীর পুজো হয়। পাদদেশে বিরাট মেলা বসে।

         পেটের মধ্যে ছুঁচোদের রেস শুরু হয়ে গেছে! পৈটিক সেবা না করলে পরিবার তো বটেই , প্রকৃতি দেখার চোখও বুজে আসবে। আধ ঘন্টার কম সময়ে পৌঁছে গেলাম বেলপাহাড়ীর খাবার হোটেল "কাঁচালঙ্কা"তে। এই বেড়ানোর সেরা প্রাপ্তি বোধহয় কাঁচলঙ্কার খাবার। মালিক বিধান দেবনাথ নিজে রান্নাও করেন। মাত্র 1বছর 3মাস বয়স হোটেলটির। অপূর্ব স্বাদ... উফঃ! চেটেপুটে খেলাম পাঁচ রকমের সবজি। রাজস্থানের থালির মতো থরে থরে সাজানো। এই অঞ্চলে এলে কোনও অবস্থায় মিস যেন না হয় ! 4 জন মাছ, মাংস, ডিম দই, 2 লিটার ঠান্ডা বোতলের জল খেয়ে বিল হয়েছিল মাত্র 515 টাকা। সব চেয়ে ভালো হয় বেলপাহাড়ীতে থেকে বেড়ানো । BDO অফিসের পাশে সরকারের তৈরি " "tarafeni cottage"। AC cottage এর ভাড়া মাত্র ₹ 1200/ টাকা। এখানে খাবেন আর কটেজে থাকবেন!

 আরও অনেক দেখা বাকী! দুধ পাহাড়(quartzite rock),হুদহুদ ঝর্না, তারাফেনী ড্যাম, ঘাঘরা... সময় কম তাই শেষ দুটো স্থান নির্বাচন করলাম। যদিও আগের দুটি সম্পর্কে স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন। বেরিয়ে পড়লাম তারাফেনী ও ঘাঘরার উদ্দেশ্যে।

@তারাফেনী ও ঘাঘরা :
বেলপাহাড়ি থেকে তারাফেনী পর্যন্ত ঝকঝকে মসৃণ পথ ।মাত্র ৯ কিমি পথ। জিপে যাওয়া যেতে পারে, কিংবা হেঁটে, সংক্ষিপ্ত রাস্তায় সময় লাগে মিনিট পঁচিশ। শাল-পিয়াল-অমলতাস-ইউক্যালিপটাসের বনবাসর ভেদ করে কিছুটা রেড রোড পায়ে চলা পথ(গাড়ী যায়) পৌঁছে দেয় রূপসী ঘাঘরায়। পাহাড়ে ঘেরা চার পাশ। চার দিকে সবুজ শালের সমারোহ। আর মাঝে বিস্তীর্ণ ব্ল্যাক স্টোনের(প্রাচীন গ্রানাইট) অজস্র গহ্বর ভেদ করে সাপের ফনার মতো ফুসছে জলরাশি। ইতিউতি মাথা উচিয়ে আছে টিলা। জলের আঘাতে এখানকার পাথরগুলির আকৃতি কলসি বা গাগড়ির মতো (পট হোল বা মন্থ কূপ- জলের তোড়ে ছোট ও মাঝারি পাথর নদী গর্ভে লাট্টুর মত ঘুরলে এই ভূমি রূপ তৈরি হয়)। স্থানীয় ভাষায় একে বলে ‘গাগরা’। সেখান থেকেই ঘাঘরা নামটির জন্ম। বহু কাল ধরেই এই ঘাঘরা স্থানীয় উপজাতি ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে অন্যতম পবিত্র স্থান। ঘাঘরার মাঝ দিয়ে বয়ে যায় তারাফেনি। অদূরেই তারাফেনি ব্যারেজ। কংসাবতীর জল বন্দি হয়েছে ১০টি লকগেটের বাঁধনে। সরকার এখানে একটি বড় মাপের পুকুরও খনন করেছে জল ধরে রাখার কাজে।

ঘাঘরা দেখতে দেখতেই বেলা প্রায় হেলে পড়েছে, হলদে রোদ পত্ররাশির গায়ে, ডালে ও শাল অরণ্যের চূড়ায়। অপরাহ্নের সেই ঘনায়ামান ছায়া এই সুপ্রাচীন স্থানকে আরও গভীর রহস্যময় সৌন্দর্য্য দান করল। মন খারাপ হওয়ার পালা ফিরে যেতে হবে গন্তব্যে! দেখা হল না বহু কিছু...বেলপাহাড়ী, গোপীবল্লবপুরের লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যাওয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।আশার কথা হোল বর্তমান সরকার এই অঞ্চলে eco-tourism চালুর চেষ্টা করছে। স্থানীয় মানুষদের হোম-স্টে করতে উৎসাহিত করতে 2.5লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তা করবে। কিছুদিন আগেই মাননীয় পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেব এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন ।
 গিধনী, জামবনি ধরে চিল্কিগড় রাজবাড়ী ছুঁয়ে ফেরার পথে দূরে নীল পাহাড়ের সারি, দিগন্ত বিস্তৃত বনানী দেখতে দেখতে আত্ম মগ্ন হয়ে পড়লাম। আজও এই হতভাগ্য আদিম জাতিগণ তেমনই অবহেলিত, শোষিত, উপেক্ষিত। আধুনিক শহরবাসী বাবু-বিবি, নেতা-নেত্রীগণ তাঁদের দিকে কখনও ফিরে চায় না ! তাঁদের দুঃখ, কষ্ট বোঝার চেষ্টা ও করেনি, আজও করে না। তাঁদের হাতের তৈরি শিল্পকলা, নিত্য ব্যবহার্য জৈব সামগ্রী উত্তরোত্তর উন্নতি করুক। প্রতিভাধর খেলোয়াড়, কষ্ট সহিষ্ণু যোদ্ধা, শিল্পীদের উপর বর্ষিত হোক দেবতাদের আশীর্বাদ। এবার পূজায় আপনাদের গন্তব্য হোক এই অপরূপ জঙ্গল মহল। দেখবেন মানুষ ও প্রকৃতি আপনাকে হতাশ করবে না! ফিরিয়ে দেবে বহুগুণ।
                         : নমস্কার :
           ------বি:দ্র:--------
বেড়াতে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়- বর্ষা পরবর্তী মাস
পলাশ দেখতে হলে মার্চ

শান্তনু -9002060927
কাঁচালঙ্কা - 8945876719
তারাফেনী কটেজ -8900360222(তুষার তেওয়ারী)
রিমিল গেষ্ট হাউস(তারক দত্ত)- 8538834032



https://m.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/2451687648216761/?mibextid=2JQ9oc

Comments

Popular posts from this blog

বেলপাহাড়ীর ঘোরার জায়গা গুলোর লিস্ট

গাড়ি ভাড়া /ঝাড়গ্রাম - বেলপাহাড়ী ট্যুর

বেলপাহাড়ীর হোম স্টে ও রিসোর্ট নাম্বার@ বিচিত্র গুপ্ত