বেলপাহাড়ীর ইতিহাস// বিচিত্র গুপ্ত
অসম্পূর্ণ ইতিহাসের আলোকে বেলপাহাড়ী// বিচিত্র গুপ্ত
ইতিহাসের ঠিক কোন সময় কাল থেকে মানুষ ভবঘুরে যাযাবর জীবন ও গুহা জীবন ছেড়ে গৃহনির্মাণ করতে শিখলো, গ্রাম এর পত্তন করলো ,সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।তবে গবেষকদের মত হলো, নব্য প্রস্তর যুগের শেষের দিকে মানুষ কৃষি কাজের বিষয়টি উদ্ভাবন করতে শুরু করে এবং গৃহ নির্মাণ শৈলী রপ্ত করতে শেখে। এই গৃহনির্মাণ শৈলীর সাথে সাথে বলা যায় গ্রামের পত্তন শুরু হলো। ঐতিহাসিক সময় কাল হিসাবে ইতিহাস গবেষকদের সিদ্ধান্ত হলো, এই পুরো প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে খ্রিস্ট পূর্ব আনুমানিক ৯৫০০ বছর থেকে ১০০০০ বছর আগে থেকে। এ ক্ষেত্রে মধ্য প্রাচ্যের মিশর, জর্ডন,লেবানন,প্যালেস্টাইন,ইসরায়েল,সিরিয়া ,তুর্কি,ইরাক ,ইরান এবং সাইপ্রাস অঞ্চল ইতিহাস গবেষকদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ন এই কারণে যে ,এই অঞ্চলেই মানুষ প্রথম কৃষি কাজের সূত্রপাত করে এবং স্থায়ী গৃহ নির্মাণ করে বসবাস ও গ্রাম নগরের পত্তন করে।১৯১৪ সালে আমেরিকান প্রত্ন - গবেষক জেমস হেনরি ব্রেস্টেড এই অঞ্চল কে " Fertile Creasent ' নামে অভিহিত করেছেন। এবং এই অঞ্চলকে ঐতিহাসিকগণ প্রযুক্তিগত নব আবিষ্কারের আতুর ঘর বা ' cradle of civilization ' বলে অভিহিত করেছেন। কেননা চাকা আবিষ্কার, চাষবাস, জল সেচ পদ্ধতি, লিখন পদ্ধতি , বন্য পশুর পোষ মানানোর মত অসংখ্য বিষয় এর সূত্রপাত হয়েছে যা পরবর্তী কালে মানব সভ্যতার বিবর্তনের ধারাকে ত্বরান্বিত করেছে ।বর্তমানের ইউফ্রেটিস নদীর তীরবর্তী দেশ সিরিয়ার "তেল আবু হুরেইরা ' ( Tell Abu Hureyra ' নামক অঞ্চলে মানুষের চাষ বাস সংক্রান্ত পৃথিবীর সব থেকে প্রাচীন নিদর্শন গুলো পাওয়া গেছে। এবং তুর্কি দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে অবস্থিত ' ক্যাটালহউক ( Catalhoyuk) অঞ্চলেই রয়েছে পৃথিবীর সব থেকে প্রাচীন নির্মিত বাড়ি গুলো । গবেষকগণ বলছেন ,এই অঞ্চলে ১১৫০০ খ্রিস্ট পূর্ব থেকে ৭০০০ খ্রিস্ট পূর্ব এর মধ্যবর্তী সময় কালে ওখানে কৃষি কাজের সূত্রপাত হয়, স্থায়ী গৃহ নির্মাণ শুরু হয় এবং গ্রাম এর পত্তন শুরু হয় । কারা এই স্থায়ী গৃহ নির্মাণ কার্য শুরু করেছিলো? নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা লগ্নের একদল মানুষ যাদের কে ঐতিহাসিকগণ ' নাতুফিয়ানস ' ( Natufians ' ) বলে অভিহিত করেছেন,তারাই প্রথম স্থায়ী গৃহ নির্মাণ শুরু করে। তারাই বন্য গম ও বার্লি জাতীয় ফসলের চাষবাস শুরু করে।এবং এই ইউফ্রেটিস নদী কে কেন্দ্র করে যে ঐতিহাসিক মানব সভ্যতার সূচনা হয়, তার নাম মেসোপটেমিয়া সভ্যতা । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আজ থেকে ১০০০০ - ১৩০০০ হাজার বছর আগের মধ্যবর্তী সময় কালে এই অঞ্চলের মানুষ প্রথম ভেড়া এবং অন্যান্য গবাদি পশুর ফার্ম তৈরি করে।এবং একই সময় কালে চিন ও ভারত বর্ষের মানুষ জল - মহিষ এবং চামরী গাই কে পোষ মানতে শেখে। চমকপ্রদ বিষয় হলো, খ্রিস্ট পূর্ব ৪০০০ বছর আগে এই অঞ্চলের মানুষ প্রথম ষাড় , গাঁধা , উট কে মালপত্র বহনের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করলো।এই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে যে ,পৃথিবীর সর্বত্র একই সাথে এই গৃহ নির্মাণ ,গ্রাম গঠন,গবাদি পশুর গৃহ পালিত করা ,চাষ বাস শুরু করা ইত্যাদি শুরু হয়নি। এখনো ভারতবর্ষের বহু দুর্গম স্থান রয়েছে যেখানে বসবাসকারি মানুষ এখনও চাষবাস শুরু করতে পারে নি, ঠিক ভাবে গৃহ নির্মাণ করতেও দেখেনি। এমন কি গৃহে পালন করার মত কোন পশুর পোষ ও মানাতে পারে নি। এখনো আধুনিক পোশাক নির্মাণ করতে শেখেনি, যন্ত্র পাতি নির্মাণ ও ব্যবহার করতে শেখে নি। দেখেনি পোড়া ইটের ব্যবহার ।জঙ্গল এবং প্রকৃতির উপর নির্ভর করেই তাদের বংশানু্রমিকভাবে জীবন অতিবাহিত হয়ে আসছে।
১৯৭৮ সালে এই অঞ্চলে প্রবাহিত তারাফেনি নদীর অববাহিকায় অবস্থিত সিজুয়া মৌজা থেকে আবিষ্কৃত প্রাচীন নর কঙ্কাল এর যে জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে , গবেষকদের মতে সেই জীবাশ্ম এর আনুমানিক বয়েস প্রায় ১০,০০০ বছর।এই আবিষ্কার এই অঞ্চলেও যে দশ হাজার বছর আগে মানুষের বসবাস ছিল,তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে।এবং যেহেতু এই অঞ্চলে অবস্থিত ধুলিয়াপুর, লালজল, বরহাপাল,ধরমপুর, আস্তাজুড়ি , আশরী গ্রাম গুলো থেকে সমসাময়িক সময়ে মানুষের ব্যবহৃত বিবিধ দ্রব্য সামগ্রী পাওয়া গেছে , সেই সব দ্রব্য সামগ্রী দেখে এটা অনুমান করা যেতে পারে যে ,ওই সব গ্রাম গুলিতে মানুষের বসবাস ছিল। এবং গৃহ নির্মাণের কোন উপাদান পাওয়া না গেলেও এটা অনুমান করতে অসুবিধা নেই যে ওই সব অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ জন কাঠ, কাদা মাটি, পাতা , বাবুই ঘাস ইত্যাদি দিয়ে গৃহ নির্মাণ করতে জানত এবং দল বদ্ধ ভাবে গ্রামেই বসবাস করতো। অনুমান করা যায়, সেই সময় এই অঞ্চলে মাত্র কয়েকটা জনপদ বিক্ষিপ্ত ভাবে অবস্থান করতো এবং সেই সব জনপদ গুলো মূলত তারাফেনী , কংসাবতী, ডুলুং,সুবর্নরেখা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।এবং গ্রাম গুলোর গৃহ নির্মাণ কৌশল ,প্রযুক্তি ,গঠন ইত্যাদি ভালো ভাবে বিচার বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে , সেই সুদূর অতীতের গৃহ নির্মাণ শৈলীর এক ধারাবাহিক নিরন্তর অনুসরন মাত্র। পৃথিবীর অপরাপর অঞ্চলের প্রাচীন গ্রামীণ গৃহ নির্মাণ শৈলীর সাথে বেশ মিল লক্ষ্য করা যায় বটে।অর্থাৎ কাঠ, বাবুই ঘাস, পাতা , মাটি ,পাথর ইত্যাদি দিয়েই এই অঞ্চলের অধিকাংশ গ্রামের বাড়ি ঘর গুলি নির্মিত হয়। আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী মানুষ টালি, টিন ,আসবেস্টাস ইত্যাদি দিয়ে ঘরের ছাউনী দিয়ে গৃহ নির্মাণ করছে। পোড়া ইট,সিমেন্ট বালি ব্যাবহার করে বাড়ি নির্মাণ করছে। এই ইট, বালি,সিমেন্ট, টিন , টালির ব্যবহার এই অঞ্চলের মানুষ ব্যাবহার শিখেছে মোটামুটি ৫০থেকে ১২০ বছরের মধ্যবর্তী সময়কালে।এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যদি খুব ভালো ভাবে অনুসন্ধান করা যায় ,দেখা যাবে জৈন ব্যবসায়ী দের নির্মিত পাথরের দেওল, পরবর্তী কালে বৌদ্ধ দের দ্বারা নির্মিত পোড়া ইটের স্থাপত্য , ঢল রাজা,মল্ল রাজা , শিলদা এর জমিদার বা রাজা দের দ্বারা নির্মিত বাড়ি ঘর মন্দির কিংবা আরো পরবর্তী কালে নীলকর সাহেব বা ব্রিটিশ দের দ্বারা নির্মিত ইটের বাড়ি ঘর ছাড়া বংশানুক্রমিক বসবাসকারী স্থানীয় মানুষ জন দ্বারা নির্মিত এমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। বা বলা যায় পোড়া ইটের ব্যবহার ,গৃহ নির্মাণ , গ্রাম নির্মাণ কৌশল এখনও সেই ভাবে বিস্তার লাভ করে নি। এমন কি পাহাড় খোদায় করে স্থাপত্য নির্মাণ ,গৃহ নির্মাণ ইত্যাদির কৌশল এই অঞ্চলের মানুষের কাছে তেমন ভাবে বিস্তার লাভ করে নি।অর্থাৎ মানব সভ্যতার ধারাবাহিক ক্রবর্ধমান অপরাপর উন্নতি সেই ভাবে এই অঞ্চলে প্রভাব ফেলতে পারে নি। এখনো বেশির ভাগ মানব বসতির মানুষ সেই সুদূর অতীতের প্রাচীন ধারা কেই বহন করে চলেছে।
বর্মানে এই অঞ্চলে , অর্থাৎ ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর দুই সমষ্টি উন্নয়ন তথা পঞ্চায়েত সমিতির অধীনে দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং মোট ৪৭০ টি গ্রাম রয়েছে। এই অঞ্চলের বহমান ইতিহাস অনুসন্ধানের সাথে আমরা বিবিধ গ্রাম নাম বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি এবং সেই গ্রাম নামের উৎসের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি।
খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন এবং বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ,এই অঞ্চলের অসংখ্য গ্রাম বা জনপদের নাম এই অঞ্চলের গাছ পালা, স্থানীয় জীব জন্তু, পশু পাখি , ভূ প্রকৃতি বা ভূ গঠন , কোন লোক বিশ্বাস বা ঘটনা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে প্রচলিত হয়েছে। এই অঞ্চল যেহেতু জঙ্গল ও পাহাড় ঘিরে গড়ে উঠেছে,স্বাভাবিক ভাবে বিবিধ গ্রাম বা জনপদের নাম জঙ্গলের বিভিন্ন গাছ কিংবা পাহাড় ডুংরির প্রভাব থাকবে , এটা অনুমান করা যেতেই পারে।
প্রথমেই পরিচয় করা যাক এই অঞ্চলের চির পরিচিত বেশ কিছু গাছ নামের সাথে।
১. শাল ২. মহুয়া/মহুল ৩. কেঁদু ৪. কুসুম ৫. আসান ৬. বেল ৭. জাম ৮. কলা ৯. আস্তা( অনেক টা চালতা গাছের মত গাছ) ১০.আগুই(বাবুই ঘাস জাতীয় গাছ) ১১. কদম ১২. করম ১৩. তাল ১৪. ধ ১৫. পিয়াল ১৬. সুশনি(শাক জাতীয় গাছ) ১৭. বান্দর পিছরা ১৮. আম ১৯. বাঁশ ২০. ছোলা ২১. কুল ২২.তেঁতুল ২৩. ডুমুর ২৪. ভুডরু ২৫. কুড়চি ২৬. ভেলা( দেশী কাজু প্রজাতি) ২৭. বহরা (বয়রা) ২৮. আমলকী /আমলা ২৯.পলাশ ৩০. জামির ( কমলা লেবু জাতীয় গাছ) ৩১. শিরীষ ইত্যাদি। এই গাছ গুলো কে কেন্দ্র করে অনেক গ্রাম গড়ে উঠেছে। এই অঞ্চলে জঙ্গলকে ' বন ' বলেই বেশির ভাগ মানুষ চেনে বা জানে। ফলে অপেক্ষা কৃত জঙ্গল ঘেরা জনপদ গুলো কে সাধারণ ভাবে স্থানীয় মানুষ জন ' বনতলা ' বলেই অভিহিত করে থাকে। এই ' বন ' শব্দের সাথে ' ই/ ঈ ' যুক্ত হয়ে 'বনী/ বনি ' তে রূপান্তরিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে ,প্রাকৃতিক ভাবে এই অঞ্চলে সব থেকে বেশি যে গাছ দেখা যায় ,সেই গাছের নাম " শাল"। এই শাল জঙ্গলের আধিক্যের মধ্যে যদি কয়েকটা জাম গাছ থেকে থাকে এবং সেখানে কোন জনপদ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তবে লোক মুখে সেই জনপদের নাম যে ' জামবনী ' হয়ে উঠেছে ,সেটা অনুমান করা যেতে পারে। একই ভাবে "শালবনী , তুলসী বনী, মহুলবনী , আগুইবনী, কেদবনী,শিরীষ বনি, বাতা বনি, তিলা বনি , ধবনি, কুড়চিবনী , বান্দরবনী , (শা) লবনী, কাঁটা( কাঁটা গাছে পূর্ন) বনি, ঝাটি (ঝোঁপ ঝার পূর্ন) বনি, পলাশ বনের আধিক্য হেতু "পলাশ বনি" ইত্যাদি"।
অপেক্ষাকৃত উচু জায়গা কে বলে "ডাঙা " । বসবাস এর জন্যে উপযুক্ত উচু নিরাপদ জায়গা স্থানীয় ভাষায় ' ডাহি / ডিহি /ডিহা " নামে পরিচিত কোথাও কোথাও উচ্চারণের সরলতার কারণে হয়ে গেছে ' ডি ' l ফলে একই ভাবে গাছ নামের সাথে এই "ডাহি / ডিহি /ডিহা/ ডি/ ডাঙা " যুক্ত হয়ে বেশ কিছু জনপদের নাম তৈরি হয়েছে বলা যায়। যেমন:
'ডিহা' যুক্ত কিছু গ্রামের নাম হলো:- জামিরডিহা, কদমডিহা,ভেলাইডিহা,কুলডিহা, ডুলুংডিহা,ডাঙর ডিহা ,বড়ডিহা,বামন ডিহা, ডাঙর ডি হা ।
( জামির ' এক রকম কমলা লেবু জাতীয় ফলে র গাছ, কদম একটি গাছ, ভেলাই - কাজু জাতীয় স্থানীয় গাছ, ডুলুং এর অর্থ একটি শিশুর নির্জনে পথ হেঁটে যাওয়া, বামন মানে আকারে ছোট ,নিচু, ডাং মানে লাঠি ,আবার ডাঙর কথা টি ' ডাঙরি ' অর্থাৎ গরু থেকেও আসতে পারে।)
' ডিহি ' যুক্ত গ্রামের নাম পালডিহি,সুনরী ডিহি, (হি),বদা ডিহি।
( বদা - পাঠা কে স্থানীয় ভাষায় বলে বদা। একটি জাত ' শুঁড়ি ' থেকে সুনরী শব্ধ এসেছে )
' ডি ' যুক্ত গ্রামের নাম বুরুডি( বুরু মানে পাহাড়),দাগডি , মেতালডি।
' ডাঙা' যুক্ত গ্রামের নাম শিমুলডাঙা,( শিমুল গাছ থেকে) কাশিডাঙা( কাশ গাছ থেকে )ফলকারডাঙা, জরক ডাঙা( জরক শব্দ এসেছে ' জরকা ' থেকে, জরকা অর্থ গরুর গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝোলানো লাঠি) মাহুত ডাঙা( মাহুত মানে হস্তি চালক), কুসুম ডাঙা(কুসুম গাছ থেকে), ভৈর ডাঙা( বাবা ভৈরব বা শিব থেকে)।
আবার ' দা ' যুক্ত কিছু গ্রাম রয়েছে। স্থানীয় ভাষায় ' দা ' শব্দের অর্থ জল। বাংলা ভাষায় জলপূর্ন হ্রদ কে ' দহ ' ও বলা হয়। তবে এই ' দা ' শব্দ টি ডিহি } ডাহি } ডহ} দ হ} দা এই পরিণত হয়েছে বলেই আমার অনুমান ।এই রকম ' দা ' যুক্ত কিছু গ্রামের নাম বিবরদা( বিবর মানে গর্ত বা গহ্বর) , লোয়াদা( লোহা এর স্থানীয় উচ্চারণ লোহা ) , হাড়দা( হরি ডিহি থেকে হাড় দা), শিলদা ( শিল শব্দ শীলা অর্থাৎ পাথর পরিপূর্ন ডিহি থেকে এসেছে)।
'পাহাড় বা পাহাড়ী ' যুক্ত হয়ে বেশ কিছু জনপদ তৈরি হয়েছে। যেমন গাঢ়পাহাড়, বাঁশপাহাড়ী,চড়ক পাহাড়ী, টুরু পাহাড়ী, ঠাকুরান পাহাড়ী, শুকনা পাহাড়ী, কুচলাপাহাড়ী, কুন্দল পাহাড়ী, খড়ি পাহাড়ী,ধুয়া পাহাড়ী।
এবার বেশ কয়েকটি শব্দের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ' ঝর্না(ঝর / ঝোর), চুঁয়া, শোল, গেড়িয়া ' জবি/জুবি, বিল। এই পাঁচটি শব্দই স্থানীয় ভাবে জলের সাথে সম্পর্কিত স্থান কে নির্দেশ করে। এই অঞ্চল অত্যন্ত রুক্ষ শুষ্ক ডাহি , ডুংরি ,টিলা ,ছোট বড় পাহাড়ে সমৃদ্ধ। মোরাম বিছানো পাথুরে মাটি।পানীয় কিংবা দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় জলের বড্ড অভাব। ফলে মানুষ তার ব্যবহারিক জীবনের অভিজ্ঞা থেকে বেশ কিছু জায়গা কে চিহ্নিত করেছিল জলের উৎস স্থল রূপে। পাহাড় থেকে যেখানে বা যে অঞ্চলে বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে মোটা মুটি সারা বছর জল ঝরত এবং বড় হ্রদের মত প্রাকৃতিক জলাশয় তৈরি করেছে এমন জায়গাকে ' ঝর্না "বা ' ঝোর বলে।এমন ঝর্না/ ঝো র যুক্ত কয়েকটি জায়গার নাম ময়ূর ঝর্না , ঝাটিঝর্না, লতা ঝর্না,, আম ঝর্না,কেটকি ঝর্না, বুড়িঝর ,কাকড়া ঝর ।
বালি পাথর পূর্ন কোন জায়গা একটু খুঁড়লে পাথর, বালি, মাটি চুইয়ে জল বের হয় এমন জায়গা কে ' চুঁয়া বলা হয়। ' চুয়া ' আছে এমন জায়গা কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কয়েকটি গ্রামের নাম ক্ত এমন আর যেখানে এমন জলাশয় বদ্ধ জলাশয়ের মত আকার ধারণ করে সেই এলাকা " শোল " নামে পরিচিত।আবার জলা জমি গুলো কেও বলা হয় 'শোল '। এই রকম ঝর্না, শোল , চুয়া যুক্ত জায়গার নাম হলো ঢাঙিচুঁয়া, বালিচুঁয়া, নটাচুঁয়া, অদল চুঁয়া, কটুচুঁয়া , কাঁকরিচুঁয়া।
এই অঞ্চলে জলা জায়গা বা জলা জমি কে স্থানীয় ভাষায় বলে ' শোল ' ।এমন জমিতে সারাবছর জল থাকবেই,এমন টাই স্থানীয় সূত্রে জানতে পারা গেছে । এমন শোল জমি কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কিছু গ্রাম হলো,
আমলাশোল, মুড়ানশোল, বাঁক শোল, বন শোল , বড় জাম শোল, ছোট জাম শোল,ঝিঙ্গা শোল, মুড়ান শোল,কেন্দি শোল, দাম শোল, ডাকাই শোল, পাকুরা শোল, টুমকা শোল, বরাম শোল ।
' শোল ' জমি অথচ প্রচুর পরিমাণে গভীর কাদা যুক্ত ,এমন হলে অনেকে বলে ' জবি/জু বি '। জবি/জুবি যুক্ত একটি গ্রাম যেমন শুসনিজবি/শুশনিজুবি।
' গেড়িয়া ' মানে ছোট পুকুর বা ডোবা। স্থানীয় মানুষ ছোট পুকুর , কিংবা ডোবা কে বলে ' গেড়িয়া ' । এমন 'গেড়িয়া' যুক্ত জনপদের নাম হলো মাজ গেড়িয়া,পচাগেড়িয়া, ফুলগেড়িয়া,শালগেড়িয়া, আঁধারগেড়িয়া,পিড়্যাগেড়িয়া ,বির গেড়িয়া।
বিস্তীর্ণ আবদ্ধ মিষ্টি জলের জলাশয় কে বলা হয় ' বিল '। বিল শব্ধ কোথাও লোক উচ্চারণে হয়ে গেছে বিলা।এমন বিল কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কয়েকটি গ্রাম হলো, আগুইবিল ( আগুই গাছে ঘেরা বিল) , চাঁদবিলা , চাঁদাবিলা ( চাঁদের মত আকার বিশিষ্ঠ বিল) ।
এবার " শোল , চুঁয়া , ঝর্না ' যুক্ত গ্রাম বা জনপদের নাম বিশ্লেষণ করা যাক। যেমন আমলাশোল । আমলা ও শোল শব্ধ যুক্ত হয়ে " আমলাশোল " নামের উৎপত্তি। আমলা একপ্রকার জলজ শাক বিশেষ। আবার "আমলকী " এর আরো একটি নাম "আমলা "।এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জঙ্গলে অনেক বুনো আমলা বা আমলকী গাছ আছে। এমন "আমলা শাক" কিংবা "আমলা গাছ। " গাছের উপস্থিতির কারণে ওই " শোল " অঞ্চল কে আমলাশোল হিসাবে লোকমুখে প্রচলিত হয়েছে ,এমন টা অনুমান করা যায়। 'মুড়ান ' শব্দের অর্থ ন্যাড়া। গাছপালাহীন উষর ন্যাড়া স্থানে অবস্থিত শোল ,লোক মুখে হয়ে গেছে " মুড়ানশোল"। কেন্দ গাছ এর উপস্থিতির কারণে হয়েছে ' কেন্দিশোল'। বাঁকা বা বাঁক আছে বলে ' বাঁক শোল"। ভালো ঝিঙে এর ফলন হত, এই কারণে একটি স্থানের নাম ঝিঙেশোল হয়েছে অনুমান করা যায়।
" ধিঙ্গী /ঢিঙি / ঢাংগি " শব্দের অর্থ হলো বড়সরো। লম্বা চওড়া । সুতরাং বড়সড় চুঁয়া কে ধাঙ্গীছুঁয়া । বড় কুসুম গাছ আছে এমন স্থানে গড়ে ওঠা জনপদ "ঢাঙিকুসুম" হয়ে উঠেছে বলা যায়। বালিতে পরিপূর্ন কিংবা বালির আধিক্যের কারণে 'বালিচুঁয়া'। নয় টি চুঁয়া এর অবস্থান হেতু 'নটাচুঁয়া'। ' অদল ' শব্দের অর্থ লম্বা ধরনের, অনেক টা গরুর গাড়ির কাঠামোর আকার বিশিষ্ট। এমন আকার যুক্ত চুয়া কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনপদের নাম হয়েছে ' অদলচুঁয়া" সহজেই অনুমান করা যায়। কটু মানে নোংরা। অযোগ্য। পানের বা ব্যবহারের অযোগ্য হওয়ার কারণে ' কটুচুঁয়া। অনেকে বলেন , লোক জিজ্জাসা " কয় টা চুঁয়া / কয় টি 'চুঁয়া " থেকেই 'কয়টি চুঁয়া /কটুচুঁয়া' নামের উৎপত্তি।
এবার আসি ' ঝর্না " তে। চারিদিকে পাহাড় জঙ্গল ঘেরা " ঝর্ণায়" বন ময়ূর তার পানীয় জল খেতে আসতো । বা কোন ঝর্নার পার্শ্ববতী জঙ্গলে থাকতো ময়ূর। ফলে স্থানটির নাম হয়েছে "ময়ূর ঝর্না " । লাটা পাটা ,ঝাটি ঝোপে ঘেরা হওয়ার জন্যে " ঝাটিঝর্না "। কাকড়া/ কাকরি পাওয়া যায় বা যেত বলে কাঁকরি ঝর্না। আম গাছের আধিক্য হেতু বা উপস্থিতি হেতু আমঝর্না। বা আমলকী গাছের উপস্থিতি থেকে আম(লা)ঝর্না হওয়া অসম্ভব নয় ,যেহেতু আগের জনপদের নাম আমলাশোল।
ডোবা/ডুবি/ডুবা মানে ডুবে যাওয়া। জলের মধ্যে ডুবে যাওয়া বোঝাতে এই শব্ধ গুলো বোঝানো হয়। আবার ডোবা মানে ছোট্ট পুকুর সদৃশ জলাশয় কেও বোঝানো হয়। তবে এই অঞ্চলে কোন কিছু ডুবে যাওয়া কে কেন্দ্র করে বেশ কিছু গ্রাম নামের উৎপত্তি হয়েছে।যেমন হাতিডোবা , চাকা ডোবা, সিঙাডুবা , উখুল্ ডোবা ,বাগডোবা ,আমাডুবি। স্থানীয় জনশ্রুতি , বয়ে যাওয়া ছোট্ট পাহাড়ি নদী তে সিং আটকে কোন গরু , কেউ কেউ বলেন কাড়া/ মহিষ ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা না কে কেন্দ্র করে এই জনপদের নাম হয়েছে, সিঙাডুবা। গরুর গাড়ির চাকা ডুবে যাওয়ার ঘটনা থেকে চাকা ডোবা, বাঘ ডুবে মারা গেছিল,তাই বাঘডোবা ,লোক মুখে বাগ/বাক ডোবা হয়ে গেছে। হাতি ডুবে যাওয়া কে কেন্দ্র করে হাতি ডোবা , এমন টা অনুমান করা যায়।
এই অঞ্চলে অসংখ্য জনপদ আছে ,যে জনপদ গুলোর নাম শেষে আছে পাড়া, পাল ,পুর ,নগর। এই পাড়া/পাল/পুর/নগর যুক্ত যে সব জনপদ গড়ে উঠেছে ,সেই সব জনপদ উপরিউক্ত জনপদ গুলোর থেকে বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন। এই গ্রাম গুলো মোটামুটি ৭০ থেকে ৪০০ বছরের মধ্যে গড়ে উঠেছে। চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব তথা তার দ্বারা প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মেরও বেশ প্রভাব বেশ কিছু গ্রামে পড়েছে ,গ্রাম গুলোর নামের দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে। যেমন কৃষ্ণপুর,শ্যামপুর,কৃষ্ণনগর,রাধা মোহন পুর, মোহন পুর, জগন্নাথ পুর,বৈষ্ণব পুর, বৈষ্টমপুর,নারায়ণ পুর, গোবিন্দ পুর,গোপাল পুর, হরিহর পুর, হরি নারায়ণ পুর, মধুপুর, মাধবপুর,রঘুনাথপুর, শ্যাম সুন্দর পুর,সিতাপুর, শ্রীনাথ পুর, ধুলিয়া পুর, রতনপুর ইত্যাদি।
'পাড়া / পাল ' শব্দটি মূলত এই অঞ্চলের অপেক্ষা কৃত পূর্বে অবস্থিত সমতল স্থানের জনপদের গ্রাম নামের সাথেই যুক্ত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ এই অঞ্চলে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আগত পূর্বাঞ্চলের মানুষদের দ্বারা পরবর্তী কালে গড়ে উঠেছে এমন টা বলা যায়।যেমন সহিস পাড়া, রাজ পাড়া, সন্দা পাড়া, কেঁদাপাড়া, লোয়া পাড়া ,বাসাপাড়া, ধুলিয়া পাড়া ,গন্ডা পাল, বড় খড় পাল, কুইলা পাল, ভাদর পাল , পাঁচ টাকার পাল , আজ্ঞা পাল ইত্যাদি।
Comments