ঝটিকা সফরে ঝাড়্গ্রাম-বেলপাহাড়ী-কাঁকড়াঝোর পর্ব ৪ // সুমেধা চট্টোপাধ্যায়
ঝটিকা সফরে ঝাড়্গ্রাম-বেলপাহাড়ী-কাঁকড়াঝোর
পর্ব ৪
@ সুমেধা চট্টোপাধ্যায়
অলৌকিক এক শ্বাপদ ও আমরা....
দুপুরের খাওয়া শেষ হতে হতেই প্রায় চারটে বেজে গেল। তারপর সবাই স্নান সেরে যখন গাড়ির সামনে জড়ো হলাম প্রায় ৫টা। ছ'টায় চিড়িয়াখানা বন্ধ হবে। কপাল ঠুকে বেরিয়েই পড়লাম। তখনও জানি না এই চিড়িয়াখানা দর্শন আমাদের জীবনে চিরস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। বৃষ্টি হচ্ছে বলে অন্যদিনের তুলনায় আগেই অন্ধকার হয়ে এসেছে। তাও আমরা সিদ্ধার্থ'র গাড়িতে সবাই 'দুগ্গা দুগ্গা' বলে উঠে পড়লাম। সাথে ছাতা-বর্ষাতি আর আমাদের অদম্য উৎসাহ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, ঝাড়্গ্রাম মিনি জু এর পোষাকি নাম 'জঙ্গলমহল জুওলজিকাল পার্ক'। ১৯৮০ সালে একটি ছোট ডিয়ার পার্ক হিসেবে চালু হলেও ধীরে ধীরে এটি এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের আধার হয়ে ওঠে। বর্তমানে ২১.৫৩ হেক্টরের এই বনাঞ্চলে স্তন্যপায়ী, পাখি ও সরীসৃপ মিলিয়ে শতাধিক প্রাণী আছে।
যথারীতি জিপিএস দিয়ে চিড়িয়াখানার প্রস্তাবিত গেটের সামনে এসে গেটটি তালাবন্ধ দেখে সিদ্ধার্থ গাড়ি ঘোরাতে যাবে, অর্য্যমা বলল 'গুগলে খোলা দেখালো, দাঁড়াও তো।' বলে একটু এগিয়ে যেতেই ভিতরে এক ভদ্রলোককে দেখা গেল তার পুত্রের হাত ধরে গেটের সামনে দিয়ে হনহনিয়ে যাচ্ছেন ভিতরে। অর্য্যমাকে সামনে দেখে আমাদের হাতের ইশারায় বোঝালেন সামনের গেটে টিকিটঘর আমরা যেন এগিয়ে যাই৷ তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটার কাছে। ভাগ্যিস গাড়ি ঘোরাই নি.... অর্য্যমার বিজয়ের হাসি মিলিয়ে পারল না আমরা সামনের গেটে এসে গাড়ি পার্ক করে বেশ ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই সদলবলে ঢুকে পড়লাম চিড়িয়াখানায়। যথারীতি জনমানবহীন। আমাদের মতো বাউন্ডুলেরাই এই দুর্যোগে শেষ মুহূর্তে আসবে এখানে। যারা ঢুকেছিলেন তারা তখন বেরিয়ে আসছেন।
সামনেই ডিয়ার পার্ক। বেশ কিছু স্পটেড ও সম্বর হরিণ দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝাঁকে। তবে আলো কমে এসেছে বেশ। তাই ছবি নেই ভালো। আরও খানিক এগিয়ে একটি aviary। আমাদের জাতীয় পাখি বিরাজ করছেন যুগলে। এছাড়া আরও বেশ কয়েক ধরণের পাখি, টিয়া....তাদের ছাড়িয়ে দেখি সেখানেই দেওয়াল দেওয়া। আর ওদিকে কিছু নেই। আমরা তখন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের পরের দিনের বেলপাহাড়ী যাওয়ার ও ঘোরার প্ল্যান করছি বেশ জোরেই, বিধান দা লাউড স্পিকারে। যথারীতি দাদা মিনিট কুড়ি-পঁচিশ এর মধ্যে গাড়ি ও ঘোরার প্ল্যান বলে।দিলেন। আমি মনের দুঃখে অর্য্যমাকে বলছি 'নেটে ভালুকের ছবি দেখেছিলাম এখানে আছে, কিছুই তো দেখলাম না।' পাশ থেকে টিনটিন বলল 'এ কেমন চিড়িয়াখানা কোন বাঘ-ভালুক নেই....' ওর কথা শেষ হতে না হতেই দেখি সেই যে ঢোকার আগে এক ভদ্রলোককে দেখেছিলাম ছেলের হাত ধরে, তার পরিবারই পাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে যাচ্ছে। এক মহিলা কণ্ঠ, খুব সম্ভবত বাচ্চাটির মাএর 'আপনারা ঐ দিকে (আমরা যেদিকে এসেছিলাম তার উল্টো দিকে) যান নি! শজারু, খরগোশ, ভালুক, হায়না, চিতাবাঘ আছে...." যা বাবা, আমরা এত ক্ষণ গল্প করে কাটালাম....ছোট্ ছোট্ ছোট্। এর মধ্যে আবার সিদ্ধার্থ, হায়নার হাসি শুনতে পেল। অবশেষে একে একে দর্শন দিলেন শজারু, খরগোশ ও হায়না।প্রায়ান্ধকার পরিবেশ ও বৃষ্টিতে তিন বন্ধু ভালুক অবশ্য বেরোলেন না।কপাল মন্দ আর কি! তারপর একটু এগিয়েই দেখি এক বিশালাকায় চিতাবাঘ একটু উঁচু জায়গায় ল্যাজ ঝুলিয়ে বসে আছেন। আমরা তাকে সামনের দিক থেকে দেখার জন্য যেই ঘুরে সম্মুখের খাঁচার কাছে গেছি ও মা দেখি দূরের টির একটি দোসর সাইজে একটু ছোট একদম দুই-তিন হাত দূরে খাঁচার গায়ে। ঠিক যেন প্রচন্ড রেগে মুখ ভেঙাচ্ছে। হাবে ভাবে মনে হল ইনি খুব বেশি দিনের অতিথি নন। এবং চিড়িয়াখানার আদব-কায়দার সাথে এখনও মানিয়ে নিতে পারেন নি। একে সন্ধ্যে প্রায়। তায় বৃষ্টি। সাথে কচি মাংসের গন্ধ। ঠিক যেন কোন এক অশরীরি শ্বাপদ-রূপে আমাদের সামনে ক্ষমতাপ্রদর্শন করছেন। আশেপাশে কেউ নেই। আমরা চারটি ধেড়ে এবং দুইটি কচি নরমাংস সামনে। যদিও সামনে ব্যারিকেড, তার ওপারে তারজালি, তাও কাঁপতে কাঁপতে উপরে তাকিয়ে দেখলাম ইলেক্ট্রিক তারও বাউন্ডারি করে দেওয়া। সব রকম সাবধানতা সত্ত্বেও এক অজানা ভয়ে কেমন যেন শীত লাগতে শুরু করল। এ যাবৎ কালে অনেক বড় বড় চিড়িয়াখানাতেই গেছি। কিন্তু এক প্রাক-পূর্ণিমা দিনে আসন্ন সন্ধ্যেবেলায় এক রাগী মাংসাশীর দাঁত-খিঁচুনি.....শিরদাঁড়া দিয়ে একটা স্রোত গেল বইকি। বেশ কয়েক মিনিট পর আবার নিঃশব্দে সে চলে গেল খাঁচার গা থেকে দূরে জঙ্গলে। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম সকলে। বৃষ্টি তখনও হালকা পড়ছে। ছ'টা পার হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। আমরাও নিঃশব্দে বেরোবার রাস্তায় পা বাড়ালাম। দেখি ভিতরের দিকে তখন একজন গার্ড হেঁটে আসছেন। হয়তো ভিতরে কেউ আর আছেন কিনা দেখতে। আমাদের মুখে তখন কোন কথা নেই। বাচ্চারাও চুপ। বাইরেই একটি চা'এর দোকানে এসে বসে সবাই একটু ধাতস্থ হল। প্রথমত জীবনে কোন চিড়িয়াখানায় সন্ধ্যেবেলায় ঢুকিও নি, এরকম অভিজ্ঞতার তো প্রশ্নই নেই।
আমরা শুধু ঐ ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ দিলাম বার বার নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায়, উনি আমাদের কথোপকথন overhear করে না জানালে এই আপাত অলৌকিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বঞ্চিত থাকতাম।
চা খেয়ে ঘরে ফিরলাম। পরের দিনের সব গোছ-গাছ সেরে রাতে রুটি/ভাত-চিকেন খাওয়া হল। সাথে ফ্রেশ স্যালাড ও শোনপাঁপড়ি ('দাঁতে -লাগা' ভার্সানটি ছিল,ঝুরঝুরে নয়। এটিই আমার অত্যন্ত প্রিয়)। এদিন আর রাত জেগে আড্ডা আমরা দিলাম না। কারণ পরের দিন বেশ সকালে বেরোনো। গন্তব্য বেলপাহাড়ী।
পরের পর্বে সুন্দরী ঘাগরা, চঞ্চল হুদহুদ ও বৃষ্টিস্নাত কাঁকড়াঝোর....এবং অবশ্যই আমাদের এই ট্রীপের সবচেয়ে বড় পাওনা বিধান'দা ও কাঁচা-লঙ্কার গল্প......
চিতাবাঘ ছাড়া বাকি সবাই এতটাই দূরে ছিল এবং আলো কমে আসার জন্য তাদের ছবি নেই।
পুনশ্চঃ আমরা ফিরে আসার পর ইনি আবার খাঁচা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ফিরে আসেন। তখন আমরা বুঝতে পারি যে উপরের তারগুলি সক্রিয় ছিল না.... আর আমরা দুই বাচ্চাসহ ফিরে আসতে পেরেছিলাম...সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
পর্ব ১ঃ https://www.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/4905216262863875/
পর্ব ২ঃ https://www.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/4914755501909951/
পর্ব ৩ঃ
https://www.facebook.com/groups/bonnerjee/permalink/4932108416841326/
Comments